ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

যশোরের বিপদাপন্ন হনুমান

যশোরের বিপদাপন্ন হনুমান

যশোর জেলার কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলায় হনুমানের দেখা মেলে

মো. ফজলে রাব্বী

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৯ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ১২:৪০

প্রায় পাঁচ বছর আগের ঘটনা। মে মাসের চিংড়ি-পোড়া গরম। রমজান মাস। সেহরি সেরেই ভোরবেলা ট্রেনে করে রওনা দিয়েছি যশোরের উদ্দেশে। সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মো. মাহাবুব আলম, শিক্ষার্থী সমী এবং অর্ণব। গন্তব্য কেশবপুর উপজেলা। ছাত্রাবস্থায় কেশবপুরের হনুমান নিয়ে গল্প শুনেছি অনেক। এইবার দেখা হবে প্রথমবারের মতো। সঙ্গে হনুমানের বিচরণ, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক এবং এর বর্তমান অবস্থা নিয়ে গবেষণার তথ্যও সংগ্রহ করব আমরা। ট্রেন স্টেশন থেকে কেশবপুর যেতে যেতে সন্ধ্যা নেমে এলো। 

পরদিন ভোরবেলা চলে গেলাম উপজেলা শহর থেকে দূরে গ্রামের ভেতর। আগের গবেষণা অনুসারে এ এলাকায় হনুমান বেশি দেখা যায়। সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরেও হনুমানের দেখা নেই। এদিকে গরমে কাহিল হয়ে আমরা ফিরতি পথে হাঁটা শুরু করি। ফেরার পথে ঝোপের আড়ালে দেখা হয়ে গেল আমাদের কাঙ্ক্ষিত হনুমানের একটি দলের সঙ্গে। প্রায় ৯-১০ সদস্যের দলে তিনটি বাচ্চাও দেখা গেল। পরে জানতে পারলাম, এরা এখন বেশি থাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে। 

বাংলাদেশে যে দশ প্রজাতির নন-হিউম্যান প্রাইমেটস পাওয়া যায়, তার মধ্যে হনুমান অন্যতম। বাংলাদেশে এটিই একমাত্র নন-হিউম্যান প্রাইমেট প্রজাতি, যা বাংলাদেশের কোনো বন বা সংরক্ষিত অঞ্চলে পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের মাধ্যমে এক জোড়া হনুমান এ দেশে আসে বা আনা হয় এবং এরা ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি শুরু করে। গবেষণা অনুসারে, হনুমানের মোট সংখ্যা এখন ২৫০-এর কাছাকাছি।

হনুমান সাধারণত দলগতভাবে বসবাস করে। প্রতি দলে ১০ থেকে ২৫ জন সদস্য থাকতে পারে। এখন পর্যন্ত যশোর জেলার কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলা থেকে হনুমানের ১১টি দলের তথ্য জানা যায়। যশোর ছাড়াও, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ফরিদপুর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরা জেলায় হনুমান রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে (বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান) এ হনুমান পাওয়া যায়। গায়ের রং হলদে বাদামি অথবা কিছুটা কমলা হয়। হাত-পায়ের দিকে কালো তালু থাকে এবং লেজ সামনের দিকে গোল হয়। সাধারণত পুরুষ হনুমান ১৮ বছর এবং নারী হনুমান ৩০ বছর বাঁচে। নারী সদস্য তিন বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয়। পুরুষের দেহ ৭০ থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১০ থেকে ১১ কেজি হয়। নারীর দেহ ৫৫ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার এবং ৯ থেকে ১১ কেজি হয়। বাংলাদেশে হনুমান বিভিন্ন ধরনের হুমকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে পাচার করা, একই রকমের গাছ রোপণ (মনোকালচার), গাছ কাটা, হনুমানের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালে আইইউসিএন এ প্রজাতিকে বাংলাদেশে বিপদাপন্ন ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করে।

২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে যশোরে এ হনুমানের ওপর ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ ল্যাবরেটরি, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান ব্যাপক গবেষণা পরিচালনা করেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সেসময় এলাকার মানুষের জন্য বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মশালা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাচ্চাদের হনুমান সংরক্ষণে উৎসাহী করতে বের করা হয় বই এবং বুকলেট। প্রাকৃতিক খাবারের প্রাচুর্য বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রকমের ফলের গাছ লাগানো হয়। মানুষের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়াতে সরকারি উদ্যোগে হনুমানের জন্য খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। এ ব্যবস্থা অপ্রতুল বলে মনে করেন এলাকার মানুষ।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলছুট হনুমান বিভিন্ন সময়ে বাস-ট্রাকে করে চলে যায়। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর এবং খুলনার বিভিন্ন এলাকায় হনুমানের উপস্থিতি দেখা গেছে। খাবার এবং আবাসস্থলের সংকটের কারণে দলছুট হনুমানের সংখ্যা বেড়েছে বলে ধারণা করা হয়। বিভিন্ন সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা, বৈদ্যুতিক তারে শক খেয়ে এমনকি হনুমানকে পিটিয়ে মারার ঘটনাও ঘটে; যা মোটেও কাম্য নয়। আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় হনুমানের অনেক ভূমিকা রয়েছে। অরক্ষিত অঞ্চলের এ প্রাণীটির খাবার এবং আবাসস্থল বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। কীভাবে এদের সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় আনা যায় সে ব্যাপারে গবেষণা করাও এখন সময়ের দাবি।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ (বন্যপ্রাণী), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

আরও পড়ুন

×