ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

আন্তর্জাতিক

ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য কী?

ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য কী?

মঞ্জুরে খোদা

মঞ্জুরে খোদা

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | ০০:৩৬ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ | ০০:৩৭

ইরানে ইসরায়েলের অতর্কিত হামলা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে। ইসরায়েল-ইরানের এই যুদ্ধে ক্রমশ বিশ্বের ক্ষমতাধর পরাশক্তিগুলোও তৎপর হয়ে উঠছে। তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছে, যুদ্ধ বন্ধে কড়া বার্তা ও হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করেছে। বিশ্ব এখনও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধকলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; তার সঙ্গে যুক্ত হলো ইসরায়েল-গাজা-ইরান যুদ্ধের ভয়াবহ ঘটনা। 
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের ক্ষতিগ্রস্ত সোরোকা হাসপাতাল পরিদর্শনের পর বলেছেন, ‘আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে আর থাকতে (বেঁচে) দেওয়া যাবে না।’ স্থানীয় গণমাধ্যম ও এএফপির বরাতে এ সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি। (সমকাল, ১৯ জুন)। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও প্রকারান্তরে ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন এবং তাদের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের’ আহ্বান জানিয়েছেন। 

ইরান আক্রমণের এই ঘটনায় ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মন্তব্য করেছেন, ‘ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে আমেরিকার হস্তক্ষেপ পরিবেশকে ‌আরেকটি ভয়াবহ উত্তেজনার দিকে নিয়ে যাবে।’ তারা ইরানে ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা না দেওয়ার জন্য আমেরিকাকেও সতর্ক করেছেন রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ। (সমকাল, ১৯ জুন)।
চলমান এই সংঘাত নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ফোনালাপে ইসরায়েলের ইরানবিরোধী পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন দুই বিশ্বনেতা। সংঘাত থামাতে ভ্লাদিমির পুতিন আবারও মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন। 
ইসরায়েল ও মার্কিনের হুমকি-আক্রমণের মধ্যেই দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইরানি জনগণকে ভয় না পেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। (বিবিসি)।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, সময় ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৪০ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজবাহী রণতরী ‘ইউএসএস নিমিটজ’ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা করেছে। এর সঙ্গে রয়েছে একাধিক গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, যেগুলো পারস্য ও ওমান উপসাগরে অবস্থানরত মার্কিন যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৬, এফ-১২ ও এফ-৩৫ মডেলের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘাঁটিতে স্থানান্তর করেছে। 
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষ আশা করেছিল, মার্কিন শাসকরা নতুন করে যুদ্ধে জড়াবে না কিন্তু তিনি সেই ভাবনায় পেরেক ঠুকে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। বিশ্ববাসী একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী চাইলেও দিন দিন যুদ্ধ-সংঘাত-রক্তপাত-প্রাণহানি জনজীবনের সংকট ও অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েলের এই আক্রমণ কি শুধু ইরানের পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার সম্ভাবনার অভিযোগ না অন্য কোনো বিষয় আছে? এই প্রসঙ্গে জিও পলিটিক্যাল ইকোনমির এক ব্লগে খ্যাতিমান সাংবাদিক বেন নরটন আটটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, ইসরায়েল-আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করছে, তার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে– ১. মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখা, ২. উপনিবেশবিরোধী ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ (প্রতিরোধ জোট) ধ্বংস করা, যাতে ফিলিস্তিনের পূর্ণ উপনিবেশকরণ সম্ভব হয়, ৩. ইরানকে কখনোই পরমাণু ক্ষমতা অর্জন করতে না দেওয়া, ৪. ইরানের স্বাধীন ও বিপ্লবী সরকারকে উৎখাত না হলে অন্তত দুর্বল করা, ৫. এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশকে– বিশেষ করে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোকে ভয় দেখানো, যেন তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ডলার থেকে দূরে সরে যাওয়ার সাহস না পায়, ৬. পেট্রোডলার ব্যবস্থা রক্ষা করা, যাতে বিশ্বজুড়ে মার্কিন ডলারের চাহিদা বজায় থাকে, ৭. রুশ-চীন নেতৃত্বাধীন ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থাকে (এসসিও) অস্থির করা, গ্লোবাল সাউথ (বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো) ভেঙে ফেলা এবং বহু-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করা, ৮. ইরান-রাশিয়া-চীন অংশীদারিত্ব ভেঙে দেওয়া, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বেইজিংকে বিচ্ছিন্ন করা।
ওই বিশ্লেষণ বলছে, চলমান হামলা-আক্রমণের প্রধান কারণ–ইরান সরকারকে উৎখাত না হয় দুর্বল করা। ইরানকে দুর্বল করাই কি ইসরায়েলের আসল উদ্দেশ্য? এ প্রসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল মাইকেল ফ্লিন ১৭ জুন স্টিভ ব্যাননের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হলো ‘চীনের ক্ষমতা দুর্বল করা’ এবং ‘মার্কিন বৈশ্বিক আধিপত্য নিশ্চিত করা’।

তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইরান সরকারকে উৎখাত করা। ভবিষ্যতে ইরানে যে নতুন সরকার আসবে, তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক সম্পর্ক থাকলে সেটি আমাদের জন্য লাভজনক হবে– বিশেষ করে চীনের বিপরীতে।’ ফ্লিন আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের বিজয় যদি ঘটে, তাহলে সেটি মার্কিন বৈশ্বিক আধিপত্যের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে– মানসিকভাবে হলেও। আর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।’

ফ্লিন, যিনি ওবামা প্রশাসনে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (ডিআইএ) পরিচালক ছিলেন এবং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলেন– এই যুদ্ধ কেবল ইরানের বিরুদ্ধে নয়, এটি একটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক কৌশল; যার লক্ষ্য চীনের প্রভাব খর্ব করে যুক্তরাষ্ট্রকে একচেটিয়া বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
মাইকেল ফ্লিন বলেন, ‘একুশ শতকের প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছে চীন। চীন, চীন, চীন– এটিই সবাইকে বুঝতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যদি আমরা এবং ইসরায়েল ইরানের সরকারকে উৎখাত করতে পারি, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার সব শক্তি ও মনোযোগ চীনের দিকে স্থানান্তর করতে পারবে।’

এই চরমপন্থি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ইউরোপীয় মধ্যউদারপন্থি নেতৃত্বের কথারও মিল পাওয়া যায়। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মার্জ ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘ইসরায়েল আসলে পশ্চিমা বিশ্বের নোংরা কাজটা করে দিচ্ছে।’ এই সব মন্তব্য ইঙ্গিত দেয়, ইরানের বিরুদ্ধে বর্তমান যুদ্ধ কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন নয়– এটি বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্নির্ধারণের লড়াই, যার কেন্দ্রে রয়েছে চীনকে মোকাবিলা করে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।

এ প্রসঙ্গে ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘আমেরিকার ক্রসেড’ বইয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থিরা একটি ‘পবিত্র যুদ্ধ’ চালাচ্ছে চীন, আন্তর্জাতিক বামপন্থা এবং ইসলাম– বিশেষত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে। ইসরায়েলকে দিয়ে ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া তাদের এই যুদ্ধ সেই অভিসন্ধিরই বহিঃপ্রকাশ।

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

আরও পড়ুন

×