সমকালীন প্রসঙ্গ
ইউরোপের ‘স্বাধীন’ হওয়ার কৌশল এবং বাংলাদেশের শিক্ষা

এফ.এম. আনোয়ার হোসেন
এফ.এম. আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫ | ০৩:১৬
গত ২৯ মে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক শার্লেমেন পুরস্কার গ্রহণকালে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন ‘সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ইউরোপ’ এবং একুশ শতকের জন্য ‘নতুন ইউরোপীয় শান্তি ব্যবস্থা’ (প্যাক্স ইউরোপিয়া) গঠনের কথা বলেছেন। তাঁর এই আহ্বানের পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক অস্থিরতা, রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর ওপর ইউরোপের অতিরিক্ত নির্ভরতা।
ন্যাটোর বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশ দেয় যুক্তরাষ্ট্র এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রকট। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে সমন্বয় করেছে, যদিও এতে ইউরোপের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ২০২৫ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর আগ্রাসী ও একচেটিয়া আচরণ, বিশেষ করে ইউরোপের ওপর প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর চাপ ইউরোপ-আমেরিকা সম্পর্ককে আরও অনিশ্চয়তায় ফেলেছে। এই বাস্তবতায় এলো ভন ডার লেনের ‘স্বাধীন ইউরোপ’ গঠনের আহ্বান।
উরসুলা ভন ডার লেনের এই কাঙ্ক্ষিত ‘ইউরোপের স্বাধীনতা’ কি শুধু ইউরোপের জন্য? বাংলাদেশ, যারা ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর এক নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আছে, তারা এই ধারণাকে কীভাবে দেখবে? ইউরোপ যেমন ন্যাটোর মাধ্যমে মার্কিন প্রভাবের মুখোমুখি, তেমনি বাংলাদেশও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বৃহৎ শক্তির সহায়তার ওপর নির্ভর করে।
ভন ডার লেন স্পষ্ট করেছেন, এই স্বাধীন ইউরোপ বিচ্ছিন্ন হবে না। বরং ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন একটি যৌথ কাঠামো, যেখানে ২৭টি দেশ তাদের কিছু জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইচ্ছাকৃতভাবে কেন্দ্রীয় ইইউ কাঠামোকে দিয়েছে, যেমন অর্থনীতি, বাণিজ্য, নিরাপত্তা নীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে। ফলে ‘স্বাধীনতা’ বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে না প্রতিটি দেশ এককভাবে চলবে। বরং একটি স্বনির্ভর, শক্তিশালী, বহির্নির্ভরতা-হ্রাসকৃত ইউরোপ গঠনের কথা বলা হচ্ছে। ভন ডার লেনের এই ‘স্বাধীনতা’র ধারণা আসলে বাইরের শক্তি, বিশেষ করে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ইউরোপকে আরও আত্মনির্ভর করে তোলার আহ্বান। রাশিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি নিরাপত্তা ও জ্বালানি সরবরাহের ওপর নির্ভরতার সঙ্গে সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটি নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অতিমাত্রায় মার্কিন প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি সতর্কবার্তা। ইউরোপ নিজের নিরাপত্তা ও শিল্পনীতিতে স্বনির্ভর হতে চায় ঠিকই, কিন্তু তাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়নি। স্বাধীন ইউরোপ মানে ‘অন্যের ছায়ায় থাকা নয়’, আবার ‘নিজের ঘরে নিজেই বন্দি হওয়া’ও নয়। বরং বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক আত্মনির্ভর, সংযুক্ত ইউরোপ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে স্বাধীন জাতি হিসেবে পথ চলছে। এই সময়ে আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছি। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করতে যাচ্ছি (২০২৬ সালের মধ্যে উত্তরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে)। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি, বৈষম্য এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ আমাদের স্বাধীনতার পূর্ণ সম্ভাবনাকে সীমিত করেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে যখন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে– এটি কি শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি একে ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী, স্বনির্ভর ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলব?
বর্তমানে বেশ কিছু সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে। ইউরোপের স্বাধীনতার ধারণা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, যদিও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ইউরোপে ভন ডার লেন প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলছেন, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে। আমাদের জন্য আমলাতন্ত্র সংস্কার মানে ডিজিটাইজেশন, সরকারি সেবাকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যাওয়া, যাতে দুর্নীতি কমে এবং সেবা দ্রুত পৌঁছায়। আর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কঠোর জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন। আমলাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনা শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ইইউ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করছে। আমাদের আমলাতন্ত্রকে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা মানে শিল্প বৈচিত্র্যকরণ, পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রযুক্তি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ এবং নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিনিয়োগ। শিক্ষা ও দক্ষতা; তরুণদের জন্য প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা। বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব সম্পদের ব্যবহার বাড়ানো। ইউরোপে ভন ডার লেন গণতন্ত্র ও আইনের শাসন রক্ষার কথা বলেছেন। বাংলাদেশে ২০২৪-এর পর গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস ও মিথ্যা প্রচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
১৯৭১ সালে আমাদের সংগ্রাম ছিল সামাজিক ন্যায়ের জন্য। এর মানে, সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, বৈষম্য হ্রাস; নারী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ। ইউরোপের মতো আমাদেরও প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, তবে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে। ইউরোপের স্বাধীনতা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে, যেখানে অন্য মহাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা মানে নিজেদের সম্পদ ও সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহার, যা বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে সম্ভব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল একটি ভূখণ্ডের রাজনৈতিক মুক্তিই নয়; আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সংযুক্ততা এবং কৌশলগত স্বনির্ভরতার এক বৃহৎ অভিযাত্রাও বটে। প্রতিষ্ঠার চার দশক পেরিয়ে গেলেও সার্ক কার্যত অচল। সাফটা (সার্ক ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) কার্যত অকার্যকর। বাস্তবে কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সংহতিই গড়ে ওঠেনি। সচিবালয়ের ক্ষমতা ও বাজেট সীমিত হওয়ায় কার্যক্রম বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। সার্ককে কার্যকর করতে প্রয়োজন সংস্কার ও সাহসী কৌশল।
সর্বসম্মতির বদলে যোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতি বিবেচনা করা উচিত। দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব সার্কের অগ্রগতির পথে যেন বাধা না হয়, এ জন্য প্রয়োজন তৃতীয় পক্ষীয় মধ্যস্থতা ও ইস্যুভিত্তিক আলোচনা। বিবিআইএন, বিমসটেকের মতো উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিতে হবে, যাতে সার্ক অচল হলেও উন্নয়ন থেমে না যায়। আঞ্চলিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত বিমসটেক দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বহুমাত্রিক সংযোগ গড়ার একটি প্ল্যাটফর্ম। এর সদস্য বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। এর ইতিবাচক দিক, ভারতের সক্রিয় কূটনৈতিক আগ্রহ ও নেতৃত্ব।
আসিয়ান ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি কার্যকর ও সফল আঞ্চলিক জোট। এর সদস্য ১০টি দেশ (ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে কাজ করছে। বাংলাদেশ এখনও আসিয়ানের সদস্য বা পর্যবেক্ষক নয়, তবে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার (এসডিপি) মর্যাদার জন্য আবেদন করেছে। এই মর্যাদা অর্জিত হলে বাংলাদেশ বাণিজ্য, জ্বালানি, বিনিয়োগ ও জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে আসিয়ানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পারবে। আসিয়ানে বাংলাদেশের আগ্রহের কারণ হচ্ছে, আমাদের ভূ-কৌশলগত অবস্থান।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক সেতুবন্ধ। আসিয়ানের বিশাল বাজারে প্রবেশাধিকার ও অর্থনৈতিক সুযোগ, সার্কের অকার্যকারিতা থেকে উত্তরণ ও আঞ্চলিক বিকল্পের সন্ধান করা দরকার। বাংলাদেশের সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে, বিমসটেকের সদস্য থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের মাধ্যমে আসিয়ান সংযোগ বাড়ানো; ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, নীল অর্থনীতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও শিক্ষা খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি। যদি বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে সঠিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মজবুত করতে পারে, তবে আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি সময়ের দাবি হয়ে উঠবে, যা বাংলাদেশ-আসিয়ান সম্পর্ক এক সম্ভাবনার পথে যাত্রা করতে পারে।
এফ.এম. আনোয়ার হোসেন: উন্নয়নকর্মী ও গবেষক
- বিষয় :
- ইউরোপ