নগর পরিকল্পনা
রাজউকের ভূতের আছর ড্যাপে

মোহাম্মদ গোলাম নবী
মোহাম্মদ গোলাম নবী
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫ | ০৪:৪২
এই ঢাকা শহরে একসময়ে গুলশান, ধানমন্ডি, বনানীসহ অনেক আবাসিক এলাকার জন্য মাস্টারপ্ল্যান ও লেআউট ছিল। পরবর্তী সময়ে নকশা পাস করার দায়িত্বে নিয়োজিতদের সঙ্গে অর্থকড়ি লেনদেন করে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোকে অপরিকল্পিত করে ফেলা হয়েছে।
২০২২ সালে ইলেকট্রনিক কনস্ট্রাকশন পারমিট সিস্টেম (ইসিপিএস) চালু করা হয়েছিল ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে। ইসিপিএস চালুর আগে আবাসন খাত-সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞ এবং একাডেমিশিয়ানরা এ পদ্ধতির দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেছিলেন। বিশেষ করে তারা দুটি জায়গাতে আপত্তি তুলেছিলেন– ১. ইসিপিএসের মধ্যে পিপি বা প্রজেক্ট পারমিট এবং ২. ইসিপিএসের মতো একটি ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্তরে স্তরে ব্যক্তিদের সশরীর উপস্থিতি ও তাদের মাধ্যমে অনুমোদন। কিন্তু নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং নকশা অনুমোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সেই সুপারিশগুলো শোনেননি। ফলে পিপি-কে কেন্দ্র করে দুর্নীতির যে সূত্রপাত ঘটে, সেটিই পরে আরও বড় আর্থিক দুর্নীতির ভিত্তি রচনা করে। সেই সুবাদে ড্যাপের মতো একটি ভালো উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে চক্রটি।
ঢাকা মহানগরীর জন্য ১৯৯৫-১৫ মেয়াদের মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নেতৃত্বে মহানগরীর ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০১৬-৩৫ প্রণয়ন করা হয়। ২০২৫ সালে এসেও সেই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। সব পক্ষই চায় ড্যাপ বাস্তবায়ন হোক। প্রস্তাবিত ড্যাপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান সমস্যা হলো, বিষয়টি বোঝার ক্ষেত্রে পক্ষগুলোর মতের ও ব্যাখ্যার ভিন্নতা। এ সমস্যার সহজ সমাধান হলো, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ অনুমোদন প্রক্রিয়াসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে ইসিপিএসের মাধ্যমে ডিজিটাল করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেখানে স্বচ্ছতা বাড়ানো ও মানুষের সম্পৃক্ততা কমানো।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী বাণিজ্যিক, আবাসিক ও সংবেদনশীল এলাকার ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) কী হবে, তা নির্ধারিত রয়েছে। যেহেতু বিষয়টি ফিজিক্যাল বা দৃশ্যমান এবং এখানে বিধিমালা আছে তাই ফার হিসাব করার দায়িত্ব ব্যক্তির ওপর ছেড়ে না দিয়ে প্রতিটি প্লটের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট করে দিলেই হয়। সেটি করা হচ্ছে না।
এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে জমির মালিকের লোভ সবচেয়ে বেশি! সেটিই লোভী করে তুলেছে রাজউকসহ সরকারি দপ্তরগুলোতে নকশা অনুমোদনে নিয়োজিত মানুষগুলোকে। সেখানে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী দালাল চক্র; যা থেকে বের হওয়ার সহজ উপায় হলো বিষয়টি ডিজিটাল ও অনলাইন করে দেওয়া। যা এখনই করা সম্ভব। দরকার শুধু নির্বাহী আদেশ। শুরুটা পুরোনো আবাসিক এলাকাগুলো দিয়ে হতে পারে। যেমন– বনানী, গুলশান, ধানমন্ডি, রূপনগরের মতো সরকারি আবাসন এবং প্রাইভেট আবাসন বসুন্ধরা, ইস্টার্নের পল্লবী, মিরপুরের আরামবাগ ইত্যাদি। এ রকম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি নির্মাণ করা হলে এর পারমিশন দিতে তো অসুবিধা থাকার কথা নয়।
বাস্তবে এই সহজ কাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে জটিল করে রেখেছে রাজউকের শর্ষের ভেতরে থাকা ভূতেরা। একই প্রস্থের রাস্তায় পাশাপাশি সমান আকারের দুটি প্লটের প্ল্যান পাস করাতে গেলে আইনের মধ্যে থাকা ফাঁকফোকর ‘বিশেষ করে ব্যক্তির বিবেচনায় রাখা সিদ্ধান্তের ফাঁক’ কাজে লাগিয়ে টুপাইস কামানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। হয়তো একটি প্লটের মালিক অর্থ দেননি বলে তাকে ছয়তলার অনুমতি দেওয়া হলো। পাশের প্লটের মালিক অর্থ দেওয়াতে তাকে বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব, বাজার ইত্যাদি শর্তের বেড়াজালে থাকা ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে তাকে ৯ তলা করার অনুমতি দেওয়া হলো।
এর সমাধান সহজ। যেহেতু প্রতিটি প্লটের ডেটাবেজ ও প্রজেক্টের মাস্টার লেআউট রাজউকের কাছে আছে। তারা প্রতিটি প্লটের জন্য ফার হিসাব করে পিডিএফ করে ওয়েবসাইটে দিয়ে দিতে পারে। সেটি ক্লায়েন্টের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে পারে। এ কথাই কিন্তু ২০০৭-০৮ সালে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) থেকে বলা হয়েছিল। তারা ঢাকার সিটি জরিপে পর্চার সঙ্গে খতিয়ান মিলিয়ে প্লট ডিজিটাল করে দিয়েছিল। রাজউকের ১৫২৮ বর্গকিলোমিটারে থাকা প্রতিটি মৌজার প্লট ম্যাপ ও সেন্ট্রাল ইমেজ তখন তৈরি করা হয়েছিল, যাতে প্রতিটি প্লটের মালিক অনলাইনে সার্চ করে তার নিজের ও আশপাশের প্লটগুলো রাস্তাসহ দেখতে পারে। সেই অনুযায়ী প্ল্যান তৈরি করে যতবার খুশি বাড়ি ভাঙতে ও গড়তে পারে। এটি যদি তখন থেকে চালু করা হতো তাহলে নতুন ব্যাখ্যা দরকার না হওয়ায় কিছু অসাধু মানুষের আয় কমে যেত। তখন কিছু কর্মকর্তা অসাধু লোকদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকারকে ভয় দেখাল যে এটি করা হলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে। সরকার আর এগোলো না। এভাবে আবাসন খাতকে কিছু ব্যক্তির স্বার্থে জিম্মি করায় আজকে অর্থনীতিতে বড় ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। এর দুর্ভোগ সমাজের উঁচুতলার মানুষ টের না পেলেও শ্রমিক, মজুরসহ ক্ষুদ্র চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
আবাসন খাতকে সচল করার আরেকটি উপায় হলো পূর্বাচলকে চালু করা। পূর্বাচল তৈরি করার দুটো কারণ ছিল– ১. এখানে একটি পূর্ণ আকারের আবাসন শহর গড়ে উঠবে। সেখানে ২৬ হাজার প্লট আছে। ২. সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট (সিবিডি) আছে। ১০ একরের মতো। যেখানে ১০ তলা করে প্রায় ৪৫টি ভবন হবে। তিনটি টাওয়ার ভবন হবে। যেগুলো ৫২ থেকে ১১০ তলা পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা স্থান রাখা হয়েছে। রাজউকের অর্থের অভাব নেই। বিপুল ক্ষমতাও আছে। এর পরও ২৮ বছরে পূর্বাচল পুরোপুরি চালু হলো না কেন? বলা হয়, সিবিডির জমি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সমাজে প্রিভিলেজড বা সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবে পরিচিতদের ‘ভাগাভাগিতে না মেলায়’ সব উদ্যোগ থমকে আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের তো ভাগাভাগির সমস্যা থাকার কথা নয়। তারা পূর্বাচলের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হচ্ছে না কেন?
আরেকটি কথা হলো, ঢাকার জন্য ড্যাপ করা হয়েছে। এটি পুরো বাংলাদেশের জন্য করা দরকার। ১০-২০ বছর ধরে ঢাকার বাইরে দেশের সব শহরে ঢাকার মতোই অপরিকল্পিতভাবে আবাসন গড়ে উঠছে। কারণ, আমাদের মনস্তত্ত্ব তো একই! আজ থেকে ২০-৩০ বছর পর ওই শহরগুলো নিয়ে ঢাকার মতোই সমস্যায় পড়তে হবে।
এখন সরকারের উচিত দ্রুততার সঙ্গে পুরো দেশের আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ শুরু করার পাশাপাশি ঢাকা শহরের পুরোনো ও পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোতে নির্মাণ কার্যক্রমের বাধা অপসারণ করা। এ খাতের সঙ্গে যুক্ত ১০ লাখের বেশি পরিবারকে খেয়েপরে বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার হওয়া দরকার। নতুবা কর্মহীন মানুষ নীরব দুর্ভিক্ষের শিকার হতে পারে। সেটি কি অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তির জন্য ভালো হবে?
মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন
- বিষয় :
- নগরায়ণ