চারদিক
সুনীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা

ছবি-সমকাল
সাবিহা সুলতানা
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ | ২৩:০৩ | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ | ১২:৫৪
পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা ও জীবন ধারণের নানা উপকরণের কাঁচামাল সরবরাহের অন্যতম উৎস সমুদ্র। বর্ধিত জনসংখ্যা, কৃষিজমি হ্রাস, অনুর্বরতা, ভূ-সম্পদ হ্রাস, ভূমিদূষণসহ নানা সমস্যায় খাদ্য ও জীবন ধারণের অন্যান্য উপকরণের সংকট তৈরি হওয়ায় তার জোগান দিতে একুশ শতকে সমুদ্রের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। সে জন্যই ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সুনীল অর্থনীতির আলোচনা।
পৃথিবীর মোট বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে সমুদ্রপথে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাণিজ্যের জন্য সমুদ্রপথ সবচেয়ে সুবিধাজনক। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘সমুদ্র নিয়ন্ত্রণে যার, বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে তার’ কথাটি বহুল প্রচলিত। এ তো গেল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রের অবদানের কথা। মানব জাতি টিকে থাকার পেছনে সমুদ্র অন্যতম নিয়ামক। খাদ্য, ওষুধ, খনিজ সম্পদ, মৎস্য সম্পদসহ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের বড় অংশ আসে সমুদ্র থেকে। এ ছাড়া সমুদ্র বায়ুমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে আছে।
পৃথিবীর শতকরা তিন ভাগ জল এবং এক ভাগ স্থল। অর্থাৎ পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ জলবেষ্টিত। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এই শতকরা হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। লন্ডন, নিউইয়র্ক, টোকিও ও সিউলের মতো উপকূলবর্তী শহর এবং মালদ্বীপ আগামী শতাব্দীর আগেই তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। অথচ সমুদ্রের অনেক অংশ আজও অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত। বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক সম্পদের খুব অল্পই ব্যবহৃত হয়েছে। এদিকে ভূপৃষ্ঠের সম্পদ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ২০১২ সালে জাতিসংঘ সর্বপ্রথম রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত রিও+২০ সম্মেলনে ‘ব্লু ইকোনমি’ শব্দটির ওপর জোর দেয়। যদিও সর্বপ্রথম ১৯৯৪ সালে বেলজিয়ামের অধ্যাপক গুন্টার পাওলি ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নে একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু ইকোনমির ধারণা দেন। তবে রিও+২০ সম্মেলনের পরই ব্লু ইকোনমি জনপ্রিয়তা পায়। অনেক উপকূলীয় দেশ গ্রিন ইকোনমির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং এর ওপর প্রযোজ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তাদের পরিস্থিতি যথাযথভাবে মোকাবিলার জন্য ব্লু ইকোনমির সমর্থনে জোরালো বিবৃতি দেয় এবং ‘গ্রিন ইকোনমি ইন অ্যা ব্লু ওয়ার্ল্ড’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ব্লু ইকোনমিকে গ্রিন ইকোনমির সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে বিবেচনা করে মহাসাগরের টেকসই ব্যবহারের তিনটি মূলনীতির প্রস্তাব করা হয়। এগুলো হলো: ১. একটি দক্ষ এবং টেকসই পদ্ধতিতে সম্পদ আহরণ, উৎপাদন এবং বাণিজ্যিকীকরণ; ২. অর্থনৈতিক লভ্যাংশ সমহারে বণ্টন এবং তার সামাজিকীকরণ; ৩. সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র কার্বন সিঙ্ক (যেসব উপাদান কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের মাত্রা কমায়) হিসেবে কাজ করে বিধায় সমুদ্রের কার্বন ফুটপ্রিন্ট (মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে প্রতিবছর যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস পরিবেশে মুক্ত হয়, তার মোট পরিমাণ) হ্রাস করা। পরে ২০১৫ সালে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৪ নম্বর লক্ষ্যের মূলকথা হচ্ছে ব্লু ইকোনমি।
বর্তমানে ক্রমশ ব্লু ইকোনমি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ ব্লু ইকোনমিনির্ভর উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, যা খুলে দিচ্ছে অপার সম্ভাবনার দ্বার এবং মানব জাতির টিকে থাকার রসদ।
সাবিহা সুলতানা: গবেষক, কৃষাণ ফাউন্ডেশন
- বিষয় :
- সমুদ্র সৈকত
- সুনীল অর্থনীতি