ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মার্কিন সেনার আত্মহত্যায় টনক নড়বে আমেরিকার?

মার্কিন সেনার আত্মহত্যায় টনক নড়বে আমেরিকার?

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন এক মার্কিন বিমানসেনা

কে এন দেয়া

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১৭:১৮ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১৮:৪৬

তার সারা গায়ে দাউ দাউ আগুন। কিন্তু মৃত্যু যন্ত্রণায় তিনি কারো নাম নেন নি, ডাকেন নি প্রিয়জনকে। শুধু দাবি জানিয়ে গেছেন, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’—ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো। তিনি আরব হতে পারতেন, হতে পারতেন ফিলিস্তিনি, কিংবা দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তের একজন শান্তিকামী মানুষ। অথচ তিনি একজন মার্কিন সেনা, তাঁর দেশের সেনারাই গণহত্যা চালিয়েছিল ভিয়েতনামে, ইরাকে, আফগানিস্তানসহ অনেক দেশে। সেই আমেরিকান বিমানসেনা ঘুরে দাঁড়ালেন। মৃত্যুর আগে লাইভ ভিডিওতে বলে গেছেন, ‘আমি গণহত্যায় জড়াতে চাই না’।

রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১টা। লাইভ ভিডিওতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাসের দিকে পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন ইউনিফর্ম পরা এক ব্যক্তি। পরে তাঁর নাম জানা যাবে ‘অ্যারন বুশনেল’ বলে।  তিনি মার্কিন বিমানবাহিনীর সক্রিয় সদস্য। গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ জানাতেই চরম দুঃসাহসী হন তিনি। নিজ হাতে তরল জ্বালানি ঢেলে দিয়ে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন তিনি।

মার্কিন বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরের বরাতে এএফপি আরও জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং টুইচে তিনি নিজের নাম ও পেশা জানান, এরপর বলেন,

‘আমি যা করতে যাচ্ছি, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার সামনে তা নিতান্তই সামান্য।‘

নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সময় তাঁকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ (ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো)।

এসব ফুটেজের সত্যতা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করতে পারেনি এএফপি। নিউইয়র্ক টাইমসের খবরের বরাতে এএফপি জানিয়েছে, টুইচ থেকে ওই ফুটেজ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

বিক্ষোভের মাধ্যম হিসেবে এমন চরম পন্থা বেছে নেওয়ার ঘটনাটি নতুন নয়। গত বছর ডিসেম্বরেও আটলান্টায় ইসরায়েলি কনস্যুলেটের সামনে এক বিক্ষোভকারী নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন। ঘটনাস্থলে একটি ফিলিস্তিনি পতাকা পাওয়া গিয়েছিলো।

তবে প্রতিবাদ হিসেবে মার্কিন সেনাবাহিনীর কারও এমন পন্থা বেছে নেওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি।

গাজার ওপর ইসরায়েলি হামলার মানসিক প্রভাব

গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে ইসরায়েলের পক্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা কারোই অজানা নেই। কোথাও চলছে ফিলিস্তিনপন্থীদের প্রতিবাদ, কোথাও চলছে ইসরায়েলপন্থীদের প্রতিবাদ।

এমন পটভূমিতে মার্কিন এক সেনার আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বিস্ময়কর বটে। কিন্তু এ ধরণের আত্মহত্যার পেছনে কী কী কারণ থাকে, বিশেষ করে মার্কিন সেনাদের মনস্তত্বের ওপর যুদ্ধ কী ভূমিকা রাখে, তা জানা থাকলে বোঝা যায় কী পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।  

প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে আত্মহনন

‘প্রোটেস্ট সুইসাইড’ অর্থাৎ প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ প্রকাশের অস্ত্র হিসেবে আত্মহনন সঙ্গত কারণেই খুব একটা দেখা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের আত্মহত্যার আসলে কারণ বের করার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল।

অ্যারন বুশনেলের ঘটনাটিতে দেখা যায়, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর মনোযোগ টানতে এবং এ বিষয়ে প্রতিবাদ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তিনি জনসম্মুখে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।

অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের আত্মহত্যাকে 'পরোপকারী আত্মহত্যা' বলা হয়, কারণ এর লক্ষ্য থাকে সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও ইতিবাচক পরিবর্তন। কখনো কখনো সেটা হতেও দেখা যায়। যেমন ২০১০ সালে তিউনিশিয়ায় এক দোকানি তার পণ্য কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন, এ ঘটনার সূত্র ধরে তিউনিশিয়া এবং আরও কিছু আরব দেশে বিপ্লবের সূচনা হয়, যাকে বলা হয় 'আরব বসন্ত।'

এছাড়াও ইরানে ফুটবল স্টেডিয়ামে নারীদের প্রবেশ রোধের প্রতিবাদে এক ইরানি নারী নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন। এর এক মাস পর ৪০ বছরের মাঝে প্রথমবারের মতো ইরানের নারীরা ফুটবল স্টেডিয়ামে প্রবেশের অনুমতি পান।

তবে এমন আত্মহননের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, এর পেছনে যে মানসিক অস্থিরতা, চাপ ও কিছু ক্ষেত্রে মানসিক অসুস্থতার ভূমিকা থাকে, তা অস্বীকার করা যায় না।

যুদ্ধফেরত ও বর্তমান সেনাদের আত্মহত্যার ঝোঁক

যুদ্ধ যে কারও জন্যই প্রবল মানসিক চাপের কারণ। যুদ্ধফেরত সেনাদের মাঝে পোস্ট-ট্রমাটিক-স্ট্রেস-ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) এবং আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ২০০৭ সালে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধফেরত মার্কিনি সেনারা আত্মহত্যার তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে।

প্রতিবেদনে একটি গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়, বেসামরিক জনগণের তুলনায় যুদ্ধফেরত সেনাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি দ্বিগুণ। এ গবেষণায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধ, ও আরব উপসাগরীয় যুদ্ধফেরত সেনারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

এ পরিস্থিতি সময়ের সাথে আরও খারাপ হয়। ১৯৯৯ থেকে ২০১১ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিদিন ২২ জন, বা প্রতি ৬৫ মিনিটে একজন মার্কিন যুদ্ধফেরত সেনা আত্মহত্যা করেন। এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছিল সিএনএন এর ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৩০ শতাংশ যুদ্ধফেরত সেনা কোনো না কোনো সময়ে আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন। আত্মহত্যা করা এসব সেনাদের ৬৯ শতাংশের বয়স ৫০ বা তার বেশি।

শুধু যে যুদ্ধফেরত আর অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি তা নয়। ২০২২ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি এক লাখ সক্রিয় সেনার মধ্যে ৩৩১ জন আত্মহত্যা করেন ওই বছর।

তীব্র মানসিক আঘাত বা ট্রমা এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ফলাফল হিসেবে অপরাধবোধ এই আত্মহত্যা প্রবণতার পেছনে কাজ করে। দ্যা ইন্টারসেপ্টের এক প্রতিবেদনে ইরাক ফেরত মার্কিন সেনাদের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় এ ব্যাপারে। যুদ্ধের ব্যাপারে তাদের যেমন মনোভাব ছিল, যুদ্ধ থেকে ফিরে সে মনোভাব প্রায় পুরোপুরি পাল্টে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বর যে হামলা হয়েছিল, তার সাথে বিন্দুমাত্র যোগ না থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে অগুনতি ইরাকির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ান মার্কিন সেনারা। বছরের পর বছর অপ্রয়োজনীয় এক যুদ্ধে লড়াই করার এই অপরাধবোধ তারা বয়ে বেড়ান, কখনো কখনো তার আত্মহত্যার প্রবণতায় রূপ নেয়।

অ্যারন বুশনেল যে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিলেন, এর পেছনে ঠিক কী মানসিকতা কাজ করেছিল? ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের হামলা এবং যুদ্ধের বর্বরতায় তিনি এতটাই বিচলিত হয়েছিলেন? নাকি মার্কিন সেনাদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতাও এর পেছনে ভূমিকা রাখে? বুশনেলের মৃত্যুর পর আর আলাদা করে এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার উপায় নেই। তার নেওয়া পদক্ষেপে ফিলিস্তিনি হামলায় ইসরায়েলের পক্ষে থাকা মার্কিন সরকারের বোধোদয় ঘটবে কিনা, তা এখন সময়ই বলতে পারে।

আরও পড়ুন

×