ঢাকা কি টেকসই শহর?
প্রতিস্বর

ইকরাম কবীর
ইকরাম কবীর
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৪০ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৪ | ০৯:৪৭
একসময় ঢাকা শহরকে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে বিশেষায়িত করা হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে। তিলোত্তমা অর্থ অপ্সরা। তখন ‘তিলোত্তমা’ শব্দটি মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকার প্রতি সারাদেশের মানুষের আকর্ষণ এই বিশেষণের পর অনেক বেড়েছিল। মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় এসে বসবাসের প্রবণতাও বেড়েছিল।
ঢাকা তিলোত্তমা নগরী আখ্যায়িত হওয়ার প্রায় এক দশক আগেই চলচ্চিত্রের একটি গান সবার মন কেড়েছিল– ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে/ লাল-লাল নীল-নীল বাত্তি দেইখা নয়ন জুড়াইছে’। মনে রাখতে হবে, সেই সময় দেশের বেশির ভাগ জেলা শহর এবং গ্রামে বৈদ্যুতিক বাতি ছিল অপ্রতুলতা। তাই আমরা সবাই বাতির দিকে ছুটে এসেছি।
ঢাকা শহরকে দেশের মানুষের কাছে ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এই দুই উদাহরণ সম্ভবত সর্বসাম্প্রতিক। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এই ব্র্যান্ডিং জেনে-বুঝে করেছিলাম? নাকি ঢাকাকে দিল্লির মসনদের মতো সবকিছুর কেন্দ্রে পরিণত করে দেশবাসীকে খুশি করতে চেয়েছিলাম? যদি তা-ই করে থাকি, তাহলে দেশের অন্যান্য স্থানকে কম গুরুত্ব দেওয়া নিঃসন্দেহে ভুল হয়েছিল। ঢাকাকে একমাত্র কেন্দ্ররূপে ব্র্যান্ডিং করার কারণেই দেশের মানুষ ঢাকামুখী এবং বাড়তে বাড়তে পরিস্থিতি এমন হয়েছে, এই শহর টিকে থাকবে কিনা– তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
স্বীকার করতে হবে, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যাই ঢাকার স্থায়িত্বের মূল চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে এমনিতেই চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা আবাসন, স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত মানুষের উপস্থিতি সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। শহরের অবকাঠামো ও সম্পদে অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করেছে। এই জনঘনত্ব এক অস্বাভাবিক ডমিনো প্রভাব তৈরি করেছে। জনসেবা করে ফেলেছে অপর্যাপ্ত।
ঢাকার কুখ্যাত যানজট শহরের অবকাঠামো ধসে পড়ারই প্রতিফলন। এই যানজট বাসিন্দাদের জন্য প্রতিদিনের বাস্তবতা হতে পারে; কিন্তু তা বায়ুদূষণ বাড়ানো থেকে সময় ও বেশি জ্বালানি খরচে আমাদের বাধ্য করছে। আমাদের কোনো কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই। ফলে ছোট ও ব্যক্তিগত যানবাহনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের পরিবেশগত স্থায়িত্বের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গেছে।
ঘন ট্রাফিক ও আবাসন শিল্পের কারণে ঢাকার বাতাস নিরাপদ সীমার চেয়ে বেশি দূষিত বলে প্রায়ই খবরে প্রকাশ। এই বিষাক্ত বাতাস বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে এবং শহরের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির গল্পই বলে। সবাই অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা পাওয়া যাবে কেমন করে?
ঢাকার সুপেয় পানির সমস্যা এবং নদীদূষণের কথা সবাই জানি। শিল্প ও মানব বর্জ্য– দুটোই নদীতে যায়। সেই নদীর কিছু পানি আমরা পরিশোধন করি পান করার জন্য। কিন্তু কতটা করতে পারি বা করতে চাই, সেই বিষয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।
ভূগর্ভস্থ পানি তুলে সব কাজ সারছি। কিন্তু অতিরিক্ত পানি মাটির নিচ থেকে তুলে ফেলছি না তো? খবরে তো তা-ই বলা হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে ১০ বছর পর আমরা কোন পানি পান করব? পানি কি আদৌ থাকবে? মাটির নিচের পানি ফুরিয়ে গেলে ভূগর্ভে শূন্যতা তৈরি হবে কিনা? যদি হয়, তাহলে আমাদের শহর দেবে যাবে কিনা?
শহরজুড়ে গ্যাসের পাইপলাইনের যে জাল ছড়িয়ে আছে এবং পাইপগুলোর অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে যে গ্যাস বেরুচ্ছে তা কতটা টেকসই বলে মনে হয়? কল্পনা করুন– একটা বড় আকারের ভূমিকম্পের সময় এই ছিদ্রের গ্যাসই শহরব্যাপী আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই শহরের একটি ভবনে আগুন লাগলেই কত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে! তা শহরে ছড়িয়ে পড়লে আমরা কী করব?
আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অদক্ষ। প্রতিদিন হাজার হাজার টন বর্জ্য আমরাই উৎপন্ন করছি এবং তা সামাল দিতে লড়াই করেও কাজ হচ্ছে না। আবর্জনা আটকে পানির পথ বন্ধ হয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শহরের জনসংখ্যার বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক বস্তিতে বাস করে। এসব বস্তিতে পরিষ্কার পানি, স্যানিটেশন এবং বিদ্যুতের মতো পরিষেবাগুলোর বিস্তর অভাব।
আমাদের নগর পরিকল্পনা ও এলোমেলো উন্নয়ন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। ঢাকার নগরায়ণের প্রসার ঘটেই চলেছে। শহর আরও বড় করা হচ্ছে। আমরা এই শহরকে কত বড় করতে চাই? যত বড় করব, ততই জ্বালানির প্রয়োজন বাড়বে। এদিকে ড্রেনেজ এবং প্রাকৃতিক জলাধারের অভাবে জলাবদ্ধতা এবং বন্যার হুমকি এখন চরমে।
ঢাকায় উপযুক্ত সংখ্যক গাছপালার অভাব শহরের সৌন্দর্য ও পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। এই ঘাটতি শহরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
এই তাপ বাসিন্দাদের জীবনের মানের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
ঢাকায় চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজমান। ধনী- দরিদ্রের মধ্যে ফারাক বিশাল। এর পরও সারাদেশ থেকে ভিটেহারা এবং বেকার মানুষ ঢাকায় আসছে। নতুন বসবাসকারীদের স্থান দেওয়ার মতো সম্পদ আমাদের কোথায়? তাহলে সামাজিক বিভাজন আরও বাড়বে না কেন?
এই বিভাজন ঢাকার স্থায়িত্বের পথকে আরও জটিল করে তুলছে। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং সুশাসনের সমস্যা সুস্থ ঢাকার জন্য গুরুতর বাধা। এসব বাধা শহরের জনসংখ্যার জীবনের চাহিদা পূরণ এবং কার্যকরভাবে নগর নীতি বাস্তবায়ন করতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে।
ঢাকার অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির কথা ভেবে দেখার মতো। এটি যদিও বিশাল জনসংখ্যার জীবিকা প্রদান করে, তবে এই খাতে অস্থিরতা রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও অনিরাপদ কর্মসংস্থানের ঝুঁকি রয়েই গেছে।
ঢাকা একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে শহরের স্থায়িত্বের চ্যালেঞ্জগুলো উৎকটভাবে চোখে পড়ে। অত্যধিক জনসংখ্যা, অবকাঠামোর চাপ, পরিবেশগত অবনতি এবং সামাজিক
অসাম্যের কথা চিন্তা করলে একটি ভয়াবহ চিত্র মাথায় আসে।
তবে ঘুরে দাঁড়ানো এখনও সম্ভব। শহরকে টেকাতে হলে একটি বহুমুখী প্রয়াস প্রয়োজন। যার মূলে থাকবে কার্যকর শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং সুচিন্তিত নগর পরিকল্পনা, যা পরিবেশনীতি বাস্তবায়নের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি।
ইকরাম কবীর: গল্পকার; যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত
[email protected]