ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

খুঁটির জোর কম হলে সাজা, বেশিতে পার

খুঁটির জোর কম হলে সাজা, বেশিতে পার

হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও তার জেসমিন ইসলামসহ নয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ছবি: সংগৃহীত

রাফি আহমদ দেওয়ান

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৪ | ২০:৫৩ | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪ | ১১:৩০

সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে লেখা ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান।’ তবে বাস্তব প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যার খুঁটির জোর বেশি তার ওপর আইনের এই ‘দৃষ্টি’ এড়িয়ে যায়। খুঁটির জোর কম হলে পেতে হয় সাজা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০২৩ এই ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট–বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি।

সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের ঘটনায় ২০১২ সালে হল-মার্ক গ্রুপের  ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী জেসমিন ইসলাম, কর্মকর্তা এবং ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। দীর্ঘ এক যুগ পর এক মামলায় মঙ্গলবার তানভীর মাহমুদ ও তার জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক আবুল কাসেম। 

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া অন্য সাতজন হলেন তানভীরের ভায়রা হল-মার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, সাইফুল হাসান, নকশি নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক ও আবদুল মতিন।

এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো আইনের ‘দৃষ্টি’ হল-মার্ক গ্রুপের  ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ওপর পড়েছে। কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে কী হলো?

সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। ওই বছর ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। যার সঙ্গে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়। আর ২০০৮ সালের পর ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে বেসিক ব্যাংকে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নানা অনিয়মের মাধ্যমে এ ব্যাংকটিতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৬০টির মতো মামলা করেছে। 

বেসিক ব্যাংকের আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। তার বিরুদ্ধে দুদকের পক্ষ থেকে ৫8টির বেশি মামলা করা হলেও বাচ্চুকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। 

এছাড়া ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে জনতা ব্যাংকে ঘটে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপ এ ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিল। এর বাইরে ২০২১ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আর্থিক খাতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা সামনে আসে। এ ছাড়া ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ৫০০ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে জনতা ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপের ৮১৬ কোটি টাকা, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে শহিদুল আহসানের ৭০১ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে এবি ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবেই এসব ঘটনা ঘটছে। কারণ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই রয়েছেন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় অনেক কিছু করতে পারে না। ফলে খুঁটির জোরেই তারা থেকে যান আইনের ‘দৃষ্টির’ বাইরে।

রাফি আহমদ দেওয়ান: সাংবাদিক, সমকাল  


 

আরও পড়ুন

×