ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

কোন পথে পাকিস্তান

দক্ষিণ এশিয়া

কোন পথে পাকিস্তান

সাঈদ ইফতেখার আহমেদ

সাঈদ ইফতেখার আহমেদ

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪ | ২১:৩৪ | আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৪ | ০৮:৫৯

পাকিস্তান তার ইতিহাসের এক নজিরবিহীন সময় পার করছে। সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কর্তৃক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর খবরদারিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে চলেছে। 

১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথম রাষ্ট্রটি দখলে নেয়। এর পর নানা সময়ে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে গেলেও রাষ্ট্রকাঠামোর মূল নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। পাকিস্তানের জন্য এ নিয়তিই সবাই ধরে নিয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতা লাভের জন্য সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হতো। সমাজ কাঠামোতে সেনাবাহিনীর সম্মানজনক ইমেজও ছিল। কিন্তু হঠাৎ এতে বাদ সাধেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পূর্বসূরিদের মতো সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ নিয়ে ক্ষমতায় এলেও পূর্বসূরিরা যে সাহস করেননি, সেটাই করে বসেন তিনি। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রাধান্যকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীন অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন ইমরান। ফলস্বরূপ সেনা এলিটদের প্রবল বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন। মূলত সেখান থেকেই পাকিস্তানি রাজনীতির বর্তমান সংকটের সূত্রপাত।

প্রশ্ন হতে পারে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কী করে এত প্রতাপশালী হয়ে উঠল যে, তারা রাষ্ট্রযন্ত্র এত দীর্ঘ সময় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হলো? 

এ বিষয়ে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের বামপন্থি তাত্ত্বিক হামজা আলাভি ‘নিউ লেফট রিভিউ’ জার্নালে ‘দ্য স্টেট ইন পোস্ট কলোনিয়াল সোসাইটিজ: পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লেখেন। তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার কালে ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে শক্তিশালী বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে এসব রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে শক্তিশালী সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র পায়। 

হামজা আলাভির এ বক্তব্যের সঙ্গে যুক্ত করা জরুরি, দুর্বল বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণকারী রাজনৈতিক দলও উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে গড়ে ওঠেনি। ফলে উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক  নেতাকর্মী গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চর্চার পরিবর্তে প্রাক-পুঁজিবাদী, ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব ধারণ করে। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা পাশ কাটিয়ে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় আসতে পারলে তা আঁকড়ে রাখার প্রবণতা রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বিদ্যমান। নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ না থাকার ফলে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দাঁড় করাতে তারা ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার প্রশ্নে বিভাজিত হওয়ার ফলে সমসত্ত্ব শ্রেণি হিসেবে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় শক্তিশালী অবস্থানে থাকে। দলগুলো দুর্বল থাকায় সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রয়াস পায় এবং বেসামরিক আমলাদের সহায়তায় এ দখল বজায় রাখতে পারে।  

মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হলেও এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আফগানিস্তানের তালেবানদের মতো শরিয়ানির্ভর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে দেখতে চাননি। জিন্নাহসহ পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা ভেবেছিলেন, ভারতের অংশ হিসেবে থাকলে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন হবে না। ফলে মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য তারা একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু সে রাষ্ট্রে অন্য ধর্মাবলম্বীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হবেন অথবা রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক হবে না– এ রকম কোনো ভাবনা তাদের ছিল না। 

পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তার মধ্যে অনেকেই ১৯৪৭-পূর্ব সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক ছিলেন। জিন্নাহসহ অনেকে এও ভেবেছিলেন, পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর সব ধর্মের অনুসারীদের সমঅধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তান একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে। একই সঙ্গে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মতো ক্রমান্বয়ে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে পাকিস্তান। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদের আন্দোলন যে ইসলাম পন্থার আন্দোলনের ফাঁদে পড়ে দিক হারাতে পারে– এ বিষয়ে তারা সচেতন ছিলেন না। 

এই দিশা হারানোর ফলেই প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান গণতান্ত্রিক-সেক্যুলার রাষ্ট্র না হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতালিপ্সার কেন্দ্রে পরিণত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব সেনবাহিনীকে জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে প্রথম রাষ্ট্রকাঠামো দখলের সুযোগ তৈরি করে দেয়। 

পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার মূল কারণ ক্ষমতা লাভের জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে বারবার সেনাবাহিনীর সাহায্য নেওয়া। সেনাবাহিনী যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই তাদের অবৈধ ক্ষমতা থেকে জনগণের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য ইসলাম পন্থার রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। তবে এটাও উল্লেখ্য, পাকিস্তানের সব ক্ষমতাসীন দল কমবেশি ইসলামকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছে। জেনারেল জিয়াউল হক ইসলাম পন্থার রাজনীতির ব্যবহারকে চরম মাত্রায় নিয়ে যান। তাঁর সময়ে আফগানিস্তানে উপস্থিত সোভিয়েত বাহিনীকে ইসলাম পন্থার ওপর নির্ভর করে পরাজিত করার যে কৌশল পশ্চিমা দেশগুলো নেয়, তার সঙ্গে তিনি পাকিস্তানকে যুক্ত করেন। এর ফলে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদনির্ভর ইসলাম পন্থার জন্ম নেয়। সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর ক্রমাগত হামলায় বর্তমানে দেশটি জর্জরিত। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিয়া-সুন্নি সমস্যা এবং সিন্ধুতে ভারত থেকে ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে আসা মোহাজিরদের আলাদা মোহাজির প্রদেশ গঠনের দাবিকে কেন্দ্র করে রয়েছে সিন্ধিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। 

এদিকে বালুচরা দীর্ঘ সময় ধরে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করতে চাইছে। শুধু জাতিগত নয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও– হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, আহমদিয়া জামায়াত সাংবিধানিক ও ব্লাসফেমি আইনের কারণে রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করছে না এবং প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। উল্লেখ্য, সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিষ্ঠিত হওয়ার অধিকার নেই। 

ইদানীং ধর্মীয় ও জাতিগত দ্বন্দ্বের সঙ্গে পাকিস্তান তার ইতিহাসের গভীরতম অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের সব সূচকে দেশটি তার সাবেক অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ আজকের বাংলাদেশ থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এসবের উপজাত হিসেবে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, লোডশেডিং ইত্যাদি কারণে জনজীবনে যে সংকট নেমে এসেছে, তার জন্য দায়ী অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা খাতে অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, সেনাবাহিনী, বেসামরিক আমলা ও রাজনীতিবিদদের চরম দুর্নীতি। 

তবে দেশের অধিকাংশ মানুষ এসব সংকটের জন্য দায়ী করছে সেনাবাহিনী ও ইসলামপন্থিদের। এর প্রতিফলন তারা দেখিয়েছে সাম্প্রতিক নির্বাচনে ইসলামপন্থি দলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে। পাশাপাশি তারা ইমরানকে দেখছে তাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসা সেনা আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম সাহসী নেতা হিসেবে। 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এখন আতঙ্কের প্রতীক ইমরান। তাই তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিরতরে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে করা হয়েছে দেড় শতাধিক ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা। শুধু তাই নয়, তাঁর দল তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) যে কোনো মূল্যে নিঃশেষ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে।

পিটিআইর সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্বে আপাতত সেনাবাহিনীকে বিজয়ী মনে হলেও আগামী দিনে অন্যান্য দলের সঙ্গেও সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব পাকিস্তানের রাজনীতির মুখ্য নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে। এ দ্বন্দ্বে যদি রাজনৈতিক দলগুলো জয়লাভ করে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার রোধে ব্যবস্থা নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে পারে; তাহলেই পাকিস্তান আজ যে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে হয়তো উঠে আসতে পারে।  

ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ: শিক্ষক, আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম, যুক্তরাষ্ট্র

আরও পড়ুন

×