শিল্পীর মূল্যায়ন হয় না কেন
শ্রদ্ধাঞ্জলি

শম্পা শ্রী
শম্পা শ্রী
প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৪ | ২২:১৯ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ১১:৩৮
মহাকালের দিগন্তরেখায় হারিয়ে গেলেন রবীন্দ্রসংগীতের নন্দিত নক্ষত্র, শিল্পী সাদি মহম্মদ! ধ্রুপদি শিল্পীর এই অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত হৃদয়বিদারক প্রস্থানে আমাদের অনুষ্ঠান আয়োজক, পরিচালক, প্রযোজক, দর্শক, জাতীয় টেলিভিশন নেটওয়ার্ক, আমি, আমাদের সবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে? চোখের সামনে যাঁকে ভালোবাসা দিতে পারিনি, সম্মান করতে পারিনি, সামান্য প্রাপ্যটুকু যাঁর হাতে তুলে দিতে পারিনি, তাঁর জন্য অন্তরালে বিলীন হওয়ার পর এতটা অনুভূতি নাড়া দিয়ে উঠছে কীভাবে?
কেন আমরা সবাই শুধু রাষ্ট্রের ওপরেই দোষ চাপাচ্ছি? ‘পদক দেওয়া হয়নি বলে অভিমানে চলে গেলেন’– চারদিকে এতটা গুঞ্জন কেন তুলছি? দায়িত্ব রাষ্ট্রের আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বাকি গোটা সমাজের কি কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না? অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেদের অক্ষমতাকে ঢেকে রাখার প্রবণতা আমাদের আছে। তাই ঘটে যাচ্ছে, ঘটছে; ঘটবে আগামীতেও। কয়জন আমি বা আপনি বা সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ, আয়োজক বা সংগঠক যোগ্য ব্যক্তিকে জীবদ্দশায় উপযুক্ত সম্মান দিয়েছি? এমনি করে আমরা হারাব আরও অনেক শিল্পী, বোদ্ধা এবং আলোকিত মানুষকে, যারা চারদিকে আলো ছড়িয়ে হারিয়ে যাবেন একদিন। আমরা এমনিভাবেই ঝড় তুলব তাদের যাওয়ার পর ,এটা নতুন কিছু নয়। তবুও বিবেকের দংশনে হৃদয়ের গভীরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই প্রহসন বন্ধ হওয়া উচিত!
আমরা ব্যক্তি হিসেবে কতজন আছি, একজন ভালো শিল্পীকে উৎসাহিত এবং তাঁর চলার পথ মসৃণ করছি? অথবা তাদের শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিচ্ছি? সবাই মামা, চাচা, লবিং, ব্রিফকেসভর্তি টাকা, নয়তো তৈল মর্দনের শিল্পকলার শিল্পী হচ্ছি এবং বাহবা নিচ্ছি। অপর পক্ষ মারহাবা মারহাবা বলে তালি বাজাচ্ছি। সংগীতশিল্পীর বারোটা বাজিয়ে বেসুরো গলায় দর্শকদের কাছে হয়ে উঠছেন তারকা– এ লজ্জা রাখি কোথায়? আবার এই আমরাই ক্ষোভ দেখাই কেন হিরো আলমদের জন্ম হচ্ছে? কিছুদিন পর হয়তো আমরাই বলব, বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র কেন একজন রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, নিয়াজ মোহাম্মদ অথবা কুমার বিশ্বজিৎ জন্মদিতে পারল না? এই দুর্ভিক্ষের জন্য হিরো আলমরা দায়ী নয় বরং দায়ী আমি, আপনি, যারা প্রকৃত শিল্পী ও শিল্পকে মূল্যায়ন না করে হিংসা বা লোভের বশবর্তী হয়ে নামধারী শিল্পীদের নিয়েই নাচি; পুরস্কৃত করি অথবা বিজয়মাল্য পরাই।
দেশে-প্রবাসে আমাদের আচরণ খুব একটা ভিন্ন নয়। দেশের মাটি ছাড়িয়ে প্রবাসে গড়ে উঠেছে আরেক টুকরো বাংলাদেশ। সেখানেও তথৈবচ!
কিছু মৃত্যু আমাদের মুখে কশাঘাত করে বিবেককে জাগিয়ে দিয়ে যায়। শিল্পী সাদি মহম্মদের মৃত্যু আমাদের মুখে তেমনি একটি কশাঘাত!
কিছুদিন আগে এক বা একাধিক রিয়েলিটি শোর সুবাদে সংগীতাঙ্গন দেখার সুযোগ হয়েছিল। অনেক কিছুই চোখে পড়েছে এবং কষ্ট লেগেছে, কিন্তু না দেখার ভান করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। কারণ সবাই বলল, এটাই নাকি সিস্টেম। আজ মনে হয়, সাদি মহম্মদ যদি একা একা কষ্ট না পেয়ে এই নষ্ট হওয়া সিস্টেম নিয়ে মুখ খুলতেন, তাহলে তাঁর তানপুরার তারে ও কণ্ঠে আজও ধ্রুপদি রবীন্দ্রসংগীত ঝংকার তুলত!
শুধু একটি প্রশ্নই বারবার মনকে বিদ্ধ করছে। আর কতকাল চলবে এমন? কাদের বোধোদয় প্রয়োজন? একজন শিল্পী দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে সারাজীবন যে শিল্পের সাধনায় আত্মদান করেন, তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন আর কবে হবে?
শম্পা শ্রী: সংস্কৃতিকর্মী, যুক্তরাষ্ট্র
- বিষয় :
- শ্রদ্ধাঞ্জলি
- সাদি মহম্মদ