সামাজিক সূচকে আশাবাদী, অর্থনীতিতে শঙ্কিত
স্বাধীনতার মাস

সারওয়ার আলী
সারওয়ার আলী
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৪৩ | আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪ | ১৬:৩৮
স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা কোন ধারার রাষ্ট্র চাই, তথা দেশবাসী রাষ্ট্রের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করে– সে বিষয়টি অস্পষ্ট ছিল না। আমরা সাধারণভাবে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিপরীতে একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কামনা করেছি। ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করে সব ধর্মের সমঅধিকার, রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছি। পাকিস্তান আমলের বৈষম্য ও একচেটিয়া পুঁজির রাজত্বের স্থলে একটি সমৃদ্ধিশালী সমঅধিকার ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র আমাদের প্রত্যাশা ছিল। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার এই আকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণ উপলব্ধি করেছিলেন। ১০ এপ্রিল ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার তার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে জানায়, ‘রাষ্ট্র জনগণের জন্য সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করবে।’ ১৯৭২-এর সংবিধানের চার নীতিতে এটি আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়। প্রধান বিবেচ্য, এ ক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রে কোনো শূন্যতা বা ঘাটতি রয়েছে কিনা?
বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর সংবিধানের মূলনীতিগুলো সংশোধিত হয় এবং প্রায় দুই দশক ধরে বিশেষত ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে দেশ ও সমাজের পশ্চাদপসরণ সুনিশ্চিত করা হয়। পরবর্তী তিন দশক ধরে দুই বছর বাদ দিলে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। বর্তমান সরকার সংবিধানের মূলনীতি প্রতিস্থাপন করেছে। বিবেচনার বিষয়, সমাজে কি সেটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? রাষ্ট্র কি তা সংরক্ষণ করে?
এই পটভূমিতে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাবনিকাশ করা যেতে পারে। গত দেড় দশকে অবকাঠামো ও বেশ কিছু সামাজিক সূচকের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর বিপর্যস্ত দেশকে যারা বাস্কেট কেস বলে অভিহিত করেছিল, তাদের হতবাক করে অভূতপূর্ব ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ও জাতীয় অর্থনীতির পরিমাণ ও পরিধির সমৃদ্ধ রূপ লক্ষণীয়। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে অসামান্য পরিবর্তন ঘটেছে। আপন অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগই নিশ্চিত করেনি, এটি বাংলাদেশের স্বনির্ভরতারও প্রতীক। অল্প সময়ে অনায়াসে মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে প্রেস ক্লাব আসা যায়। এখানে ডিজিটাইজেশনের বিস্তৃতি লক্ষণীয়। তবে এই ব্যয়বহুল উন্নয়নের ক্ষেত্রে অভিযোগ, অনেক প্রকল্পে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশিই ব্যয় করছে। সামাজিক সূচকের ক্ষেত্রেও উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় উন্নততর চিত্র দেখা যায়। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার বহুলাংশে কমেছে; গড় আয় ও আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আশ্রয়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ নানা কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে এবং তার সুফল দরিদ্রজন লাভ করছে।
উপরোক্ত চিত্রপট আমাদের স্বদেশ সম্পর্কে আশাবাদী করে। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত, কার্যক্রম ও সামাজিক কিছু প্রবণতা আমাদের প্রাণে হতাশা, এমনকি গভীর শঙ্কার জন্ম দেয়। এর ফলে যে দুর্ভোগ, তা কেবল স্বল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; সমগ্র দেশবাসীর জনদুর্ভোগের কারণ। অবিলম্বে এটি নিরসনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে দেশ বিপদগ্রস্ত হবে। এর ফলে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা জনমনে ম্লান হবে। এর গভীরে রয়েছে ধর্ম ও জাতিগত বিদ্বেষ তথা সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ও লোভের সর্বগ্রাসী বিস্তার। এর ফলে সমাজের অধোগতি নৈতিকতার প্রান্তরেখা অতিক্রম করতে উদ্যত।
আমাদের ন্যূনতম প্রত্যাশা ছিল, বহুত্ববাদী সমাজে সব ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাংলাদেশকে নিরাপদ বাসস্থান বিবেচনা করবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে অবধি ধারাবাহিকভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়, বসতবাটি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। তিন বছর ধরে নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা আয়োজন প্রমাণ করেছে– সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক শক্তির সহায়তায় এটি সম্ভব। তবে মৌলিক সমস্যা হচ্ছে সমাজে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক শ্রেণির ধর্মগুরুর নিয়ন্ত্রণহীন ধর্মবিদ্বেষী, নারীর প্রতি মর্যাদাহানিকর ও সংস্কৃতিবিনাশী প্রচারণায় প্রভাবিত হচ্ছে সমাজ ও ব্যক্তি।
লোভের সর্বগ্রাসী বিস্তার সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ব্যাংকিং কার্যক্রম চরম ঝুঁকির সম্মুখীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী; মুদ্রা পাচার ভয়াবহ, রাজনৈতিক তদবিরে অনুমোদিত অসফল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, তারল্য সংকট, রিজার্ভের পরিমাণের সমস্যা বিপজ্জনক ইঙ্গিত বহন করে। ইতোমধ্যে ডলার সংকট ও টাকার অবমূল্যায়ন স্বাভাবিক ব্যবসা ও শিল্প পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সর্ব পর্যায়ে দুর্নীতির ফলে মানুষ দিশেহারা। এর ফলে ধনবৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এক দল অতি ধনী সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার সচেতন, কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হচ্ছে না।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জীবন মূল্যস্ফীতির কারণে বিপর্যস্ত। এটি দেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে সরকার চিহ্নিত করেছে। কিন্তু খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রীর বেহিসাবি মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সমর্থ হচ্ছে না। ডলার সংকট ও টাকার অবমূল্যায়ন কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে। কিন্তু অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধির জন্য তাদের সম্পূর্ণ দায়ী করা যাবে না।
বস্তুতপক্ষে দেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি ও কিছু সামাজিক সূচকের উন্নতি আমাদের আশাবাদী করে; অন্যদিকে অনিয়ন্ত্রিত ধর্মবিদ্বেষী প্রচারণা আমাদের হতাশাগ্রস্ত করে। তদুপরি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য আমাদের শঙ্কিত করে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করছে।
স্বস্তির বিষয়, সরকার সমস্যাদি স্বীকার করে এবং নিরসনে সক্রিয় বলে জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নজরদারি ও জবাবদিহির বিষয়টি গুরুত্ববহ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহির কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদ। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান জাতীয় সংসদের বিরোধী দল ক্ষীণকায়। সুতরাং এ দায়টি গ্রহণ করতে হবে তথ্য মাধ্যম ও সামাজিক শক্তির। একান্ত প্রত্যাশা, এ কর্তব্য পালনে তাদের দলীয় আনুগত্য কিংবা সংকোচন নীতি বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না। সরকার এই জবাবদিহিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমালোচনা নয়, নাগরিক উৎকণ্ঠা হিসেবে বিবেচনা করবে।
ডা. সারওয়ার আলী: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
- বিষয় :
- স্বাধীনতা
- অর্থনীতি
- মূল্যবৃদ্ধি
- ধর্ম