ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মস্কো হামলার প্রভাব ইউক্রেন যুদ্ধে পড়তে বাধ্য

আন্তর্জাতিক

মস্কো হামলার প্রভাব ইউক্রেন যুদ্ধে পড়তে বাধ্য

ফাইল ছবি

এম কে ভদ্রকুমার

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৪ | ০০:২৩

গত ৭ মার্চ মস্কোতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে জারি করা একটি অযাচিত পরামর্শমূলক বার্তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। এতে বলা হয়েছিল, ‘মস্কোর বড় রকমের জনসভায় চরমপন্থিদের হামলা করার পরিকল্পনা রয়েছে, সেটা কনসার্টও হতে পারে।’ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বড় ধরনের জনসভা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যও সতর্ক করা হয়েছিল। ঘটনার পরপরই অন্তত স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তা নিয়ে কূটনৈতিক তর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। আমেরিকানরা দাবি করেছিল, তারা এ ব্যাপারে রাশিয়াকে তথ্য দিয়েছে। একইভাবে তারা মস্কোর নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর অযোগ্যতার দিকেও ইঙ্গিত করেছিল, যদিও রাশিয়া এ পরামর্শে সুনির্দিষ্ট কিংবা উদ্যোগ নেওয়ার মতো কিছু ছিল না বলে জানিয়েছে।     

তারপরও পরদিন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণে বলেন, ‘অপরাধীরা ইউক্রেনের দিকেই পালানোর চেষ্টা করেছিল। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, সীমান্ত পাড়ি দিতে ইউক্রেনের দিক থেকে একটা পথও প্রস্তুত করা ছিল।’ তবে তদন্ত চলমান বলে তিনি সরাসরি কারও প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা থেকে বিরত থাকেন।   

পুতিনের বক্তব্য থেকে মনে হয়, ঘটনার নেপথ্যের কলাকুশলী অপরাধীদের অভিযান শেষে বিশেষ একটি রাস্তা ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে ইউক্রেন সীমান্ত পার হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল। ইউক্রেনের সীমান্তে তাদের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল। প্রথম কথা, ‘জানা-অজানার রাজ্যে’ যে বিষয়টি বাকি থাকল তা হলো, চেইন অব কমান্ড। দ্বিতীয় কথা হলো, ওয়াশিংটন আইসিস আক্রমণ করেছে বলে প্রচারণা চালিয়েছে। আদতে পাশ্চাত্য গণমাধ্যম খুব জোরেশোরে এই প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। এ ধরনের তথ্য প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি বোবা বুদ্ধিমানদের বিভ্রান্ত করা।     
বাস্তবে অভিযানটিতে অপরাধীরা আইসিস হত্যাকারীদের মতো আচরণ করেনি, যারা শহীদ হতে চায়। কিন্তু এখানে তারা গুপ্ত হামলা কিংবা হামলা চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছে। ভিডিও নিরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, অপরাধীদের চলাফেরা দেখে তাদের দক্ষ যোদ্ধা বলে মনে হয়নি। তা ছাড়া অস্ত্র রাখার ক্ষেত্রে তাদের শৃঙ্খলায়ও যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। তার মানে, অস্ত্র চালনা নিয়ে তাদের ন্যূনতম প্রশিক্ষণ ছিল। মোদ্দাকথা, টাকার লেনদেনের বিষয় বাদ দিলে ঘটনাটি মূলত হিংসার সর্বোৎকৃষ্ট নজির তুলে ধরে।     

রাশিয়ার বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা (এসভিআর) গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে অভিযোগ তুলেছে, সম্প্রতি মার্কিন সামরিক বাহিনী নতুন করে পূর্বতন আইসিসের পুনরুত্থান ঘটাচ্ছে। তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ভূখণ্ডে ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য জিহাদি যোদ্ধাদের সংগ্রহ করছে।

২৬ মার্চ ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের পরিচালক আলেক্সান্দার বর্টনিকভ এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ পর্যন্ত আটকদের জেরা থেকে ঘটনায় রাজনৈতিক কারণ আছে বলে জানা যাচ্ছে। চরমপন্থি ইসলামিস্টরা নিজেরা এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর জন্য সক্ষম ছিল না। তাদের বাইরে থেকে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। তাঁর মতে, সেটা যেভাবেই হোক, এখন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা-ই দেখা যাচ্ছে; যেহেতু হামলাকারীরা ইউক্রেন ভূখণ্ডের দিকেই এগিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে সেটিই
উঠে এসেছে।  

রাশিয়ার পর্যবেক্ষণমতে, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা বাহিনীর সহযোগিতা, স্যাটেলাইট ছবি, এমনকি পাশ্চাত্য শক্তির পরামর্শ ছাড়া রাশিয়ার ভেতরে অথবা দেশটির যুদ্ধ নৌবহরে হামলা চালানোর সক্ষমতা ইউক্রেনের নেই। কিন্তু পাশ্চাত্যের পরাশক্তি বারবার রাশিয়ার এই অভিযোগ অস্বীকার করে যাচ্ছে।     

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, ভূরাজনীতিতে ক্রোকাস সিটি হল আক্রমণের ঘটনার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথের ওপর এ হামলার প্রভাব পড়বে। এ মুহূর্তে দৃঢ়তার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করা পুতিনের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা, রাশিয়ার জনগণ চাইবে আশপাশের সব অন্ধকারের শক্তি পুরোপুরি উপড়ে ফেলা হোক।   

ভুলে যাওয়া যাবে না, রাশিয়ায় গোপন অভিযান চালানো এবং দেশটিকে অস্থির করে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে যে বিশাল অবকাঠামো গড়ে তুলেছে, তারা তা চালিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। যেভাবেই হোক তারা সেগুলো অব্যাহত রাখবে। পাশ্চাত্য কৌশলের মূলকথা হলো, রাশিয়াকে দুর্বল করে দেওয়া এবং বিশ্বমঞ্চে দেশটিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে ভূমিকা রাখতে বিরত রাখা। সাম্প্রতিক নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানমতে, ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের সবখানে সিআইর সূত্র রয়েছে।

টিএস এলিয়টের মার্ডার ইন দ্য ক্যাথেড্রাল নাটকের কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে– ‘হাতুড়ি ও নেহাইয়ের মারপিটে কিবা শান্তি পাওয়া যায়।’ নাটকীয়ভাবে যুদ্ধ বাড়বে, এটাই নিয়তি। সেখানে পাশ্চাত্য বাহিনীর মোতায়েন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ ইউক্রেনের শক্তি নিঃশেষ হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোকে সরাসরি মাঠে নামতেই হবে। অন্যদিকে রাশিয়ার সামনেও একটা সামগ্রিক সামরিক বিজয় ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

এম. কে. ভদ্রকুমার: ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম

 

আরও পড়ুন

×