সারওয়ার ভাইকে মনে পড়ে
জন্মদিন

সেলিনা হোসেন
সেলিনা হোসেন
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৪ | ২৩:১২ | আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৪ | ০৯:৫৬
মনে হয়, এই তো সেদিন। অথচ ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেল ছয় বছর। মনে আছে, ২০১৮ সালে সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, আমাদের প্রিয় সারওয়ার ভাই ৭৫ বছর পূর্ণ করেছিলেন। এ উপলক্ষে আমরা, তাঁর বন্ধু, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা একত্র হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। অনেক আড্ডা-আলোচনায় দারুণ এক সন্ধ্যা কেটেছিল। কে জানত, সে বছরই সারওয়ার ভাই আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন! আমাদের ছিল চার দশকের জানাশোনা। যখনই তাঁর কথা ভাবি, কত স্মৃতি এসে ভিড় করে!
দুই.
মনে পড়ে, তখন ১৯৭৭ সাল। বাংলা একাডেমির চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছি মাস দুয়েকের জন্য। আমার ছেলে শমিকের জন্ম হবে। শুধু শুধু ঘরে বসে থাকা যায় না। একটি নতুন উপন্যাস লিখতে শুরু করি। অল্প সময়ে একশ পৃষ্ঠা লিখে শেষ করি। লিখতে বেশ আনন্দ পাচ্ছিলাম। মনে হতো, উপন্যাসের নায়ক আনন্দ আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। একদিন কবি ইকবাল হাসান আমার মনিপুরীপাড়ার বাসায় আসে। বলে, সারওয়ার ভাই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। হায়, এই ইকবাল হাসানও গত বছর এপ্রিলে সুদূর কানাডায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
আমি ভ্রু কুঁচকে ইকবালের দিকে তাকাই। জিজ্ঞেস করি, সারওয়ার ভাই কেন আমাকে মনে করেছেন?
ইকবাল হেসে বলে, কারণ তো একটাই। সাপ্তাহিক পূর্বাণীর ঈদসংখ্যা হবে। আপনার কাছ থেকে একটি উপন্যাস চেয়েছেন।
আমি যেমন অবাক হই, তেমন খুশিও।
বলি, সারওয়ার ভাই আমার কাছ থেকে উপন্যাস চাচ্ছেন?
ইকবাল মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ে।
সে সময়ে আমার দুটি উপন্যাস লেখা হয়েছে। একটি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, অন্যটি ‘পদশব্দ’। তখন পর্যন্ত আমি খুব পরিচিত লেখক নই। পূর্বাণী সিনেমা-বিষয়ক পত্রিকা ছিল। বেশ বড় আকারে ঈদসংখ্যা প্রকাশ করত। সারওয়ার ভাই ছিলেন এই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। তিনি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদকও। পূর্বাণী ছিল ইত্তেফাক হাউসের সিনে সাপ্তাহিক। দৈনিক পত্রিকার আকারে প্রকাশিত হতো। প্রায়ই পড়তাম। তখন পর্যন্ত সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে সামনাসামনি যোগাযোগ হয়নি। পত্রিকার ঈদসংখ্যার জন্য তিনি আমার লেখা চেয়েছেন জেনে খুশিই হলাম।
মনোযোগ দিয়ে উপন্যাসটি শেষ করার চিন্তা করি। প্রায় দুইশ পৃষ্ঠা লেখা শেষ হয়। উপন্যাসের নাম রাখি ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’। একদিন ইকবাল ফোন করে, আপা, লেখা শেষ হয়েছে? বলি, লেখা শেষ হয়েছে, কিন্তু উপন্যাস তো দুইশ পৃষ্ঠার মতো হয়েছে।
ঈদসংখ্যায় ছাপা সম্ভব হবে কি?
ইকবাল বলে, সারওয়ার ভাইকে জিজ্ঞেস করে আমি আবার যোগাযোগ করছি। পরদিন ইকবাল এসে হাজির। বলে, সারওয়ার ভাই বলেছেন, পুরো উপন্যাসই ছাপবেন। কোনো অসুবিধা হবে না। আমাকে দিয়ে দিন।
তখন উপন্যাসটির ফটোকপি রেখেও দিতে পারিনি। পুরো পাণ্ডুলিপি ইকবাল হাসানের হাতে দিয়ে দিই। একবারও ভাবিনি, কোনো দুর্ঘটনায় আমার এত বড় লেখাটি হারিয়ে যেতে পারে। যথাসময়ে ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ উপন্যাস ছাপা হয়। আগের দুটো উপন্যাসের চেয়ে এই উপন্যাসের পাঠক প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি পেয়েছিলাম। সব পাঠকই ছিলেন পূর্বাণী ঈদসংখ্যার। তারা যেভাবে ভালো লাগার কথা জানিয়েছিলেন, তা আজও আমার স্মৃতির সঞ্চয়। এখন যেসব পত্রিকার ঈদসংখ্যা হয়, তারা কেউ দুইশ পৃষ্ঠার উপন্যাস ছাপতে পারে না। সারওয়ার ভাইয়ের হাত দিয়ে একসময় সেটা সম্ভব ছিল।
তিন.
সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল সম্ভবত বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমির চাকরিসূত্রে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে। লেখকদের সঙ্গে তো বটেই। তারা আসতেন বই প্রকাশনার কাজে, পত্রিকায় লেখা দেওয়ার জন্য কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে। কোনো এক সময় সেভাবেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তারপর পরিচয়ের সূত্র আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। কত না কতভাবে স্মৃতির খেরো খাতা ভরে ওঠে! পরিচয়ের মাত্রা বাড়লে সে পরিচয় শুধু একজন ব্যক্তিকে ‘কেমন আছেন’ জাতীয় জিজ্ঞাসার মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ থাকে না। তাঁর কাজের নানা মাত্রা সামনে আসতে থাকে। কাজের মাত্রায় যদি দেশ, সমাজ সম্পৃক্ত হয় তবে তা ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে গড়ায়। সারওয়ার ভাই এভাবেই আমার কাছের মানুষ। পরবর্তী সময়ে সমকাল ও ব্র্যাক ব্যাংক যৌথভাবে যে সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে, এর বিচারকমণ্ডলীতে থাকার সুবাদে সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিবছরই একাধিকবার দেখা হতো, কথা হতো। আর সেই যে পূর্বাণীর ঈদসংখ্যায় লেখা শুরু হলো, সেটা পরেও অব্যাহত থেকেছে। সারওয়ার ভাইয়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত যুগান্তর ও সমকালের ঈদসংখ্যাতেও লিখতে হয়েছে। সম্পাদক ও লেখকের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছাপিয়ে গোলাম সারওয়ার হয়ে উঠেছিলেন আমার ভাই।
চার.
সারওয়ার ভাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এই জানা আমাকে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে বলে। তিনি বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে বাংলা একাডেমির মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজেদের গৌরবের দিনের কথা বলতেন। স্মৃতিচারণ করতেন কিংবা বিশ্লেষণ করতেন ইতিহাস-ঐতিহ্যের। মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য অর্জনকে আপন কণ্ঠে তুলে নিয়ে বলতেন বাঙালির আত্মপরিচয়ের কথা। বলতেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা।
সাংবাদিক হিসেবে সারওয়ার ভাই তাঁর চিন্তায় পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরাতেন। এই চিন্তা সমাজমনস্ক মানুষ হিসেবে দেশ ও জাতির কথা বলত। তাঁর চিন্তা ছিল প্রগতিশীল মুক্তমনের মানুষের জন্য অগাধ ও উচ্চকণ্ঠ।
সারওয়ার ভাইয়ের লেখক সত্তা অনেকের কাছে অজানা। কিন্তু লেখার জগৎকে নিজের কুণ্ঠাহীন প্রকাশ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন। এমন মানুষই সমাজের খুঁটিগুলো শক্ত রাখতে ভূমিকা পালন করে। তাঁর বইয়ের নাম ‘সম্পাদকের জবানবন্দি’। গণমানুষের আদালতে দাঁড়িয়ে নিজের বিবেকতাড়িত হয়ে জবানবন্দি দেওয়ার সাহস ক’জনেরই-বা থাকে! বইয়ের নাম ‘অমিয় গরল’। এই লেখাগুলোও নিজেকে একই সমান্তরালে প্রকাশের ইচ্ছা। বইয়ের নাম ‘আমার যত কথা’। আবার নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন গণমানুষের মুখোমুখি। পরের বই ‘স্বপ্ন বেঁচে থাক’। মানুষের স্বপ্ন নিয়ত ফুরিয়ে যায়। মানুষের স্বপ্ন নিয়ত পথ হারায়। তাই স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা গভীর সাধনা। লেখকের স্বপ্নে-বাস্তবে যে ভালো-মন্দের বোধ, তাকে একসঙ্গে বয়ে নিয়ে যেতে স্বাপ্নিক মানুষই পারে। সারওয়ার ভাই এর বাইরের মানুষ ছিলেন না। তাই তো ছোটদের জন্য লিখেছেন ছড়ার বই ‘রঙিন বেলুন’। শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইটি শিশুদের হাত ধরে নিয়ে গিয়েছে সৃজনশীল জগতে। তবে এই একটি মাত্র বইয়ে শেষ করেছেন নিজের শিল্পভাবনা। এমন আকস্মিকভাবে গুটিয়ে না গেলেও পারতেন তিনি। এই থেমে যাওয়ার ঘটনা আমাকে আহত করে যখন নিজের স্মৃতির কাছে ফিরে যাই। সাপ্তাহিক ‘পূর্বাণী’র ঈদসংখ্যায় ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ উপন্যাসের মুদ্রিত পৃষ্ঠা কল্পনা করি, যখন পূর্বাণীর পাঠকের কাছ থেকে উপন্যাসের পাঠকের ভালো লাগার কথা জানতে পারি।
১৯৭৭ সালে সারওয়ার ভাইয়ের বয়স ছিল ৩৪। তখনই তিনি সৃজনশীল সাহিত্যকে গুরুত্বের সঙ্গে জায়গা করে দিয়েছিলেন পত্রিকার পৃষ্ঠায়। তিনি ব্যাংকের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্য পুরস্কারের প্ল্যাটফর্ম। সেখান থেকে এখনও প্রবীণ লেখকের পাশাপাশি পুরস্কৃত হচ্ছে নবীন লেখকরাও। একদিকে প্রবীণরা সম্মানিত হচ্ছেন, অন্যদিকে নবীনরা উৎসাহিত হচ্ছে। তারাই তো সাহিত্যের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সৃজনশীল মানুষের কর্মের পরিসর বাড়িয়ে চলে গেছেন সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। তিনি তাঁর জগৎকে আলোয় ভরে গেছেন সৃজনশীল কর্মযজ্ঞে।
পাঁচ.
আমি মনে করি, গোলাম সারওয়ার এক সার্থক জীবন কাটিয়ে গেছেন। তিনি বাংলাদেশের সংবাদপত্রে নতুন যুগের সূচনা করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সম্পাদনার ধারা এখন আরও অনেক পত্রিকায় অনুসৃত। বস্তুত দীর্ঘ ৫৬ বছর ধরে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি যেভাবে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় ও অনুপ্রেরণামূলক না হয়ে পারে?
একুশে পদকপ্রাপ্ত সম্পাদক, লেখক সারওয়ার ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর জীবন, কর্ম, বন্ধুত্ব, পরোপকারিতা রেখে গেছেন আমাদের জন্য। আমাদের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা তাঁর প্রতি। ৮২তম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি
কামনা করি।
সেলিনা হোসেন: কথাশিল্পী
- বিষয় :
- জন্মদিন
- গোলাম সারওয়ার
- স্মরণ