নবপল্লব: পল্লবিত হোক প্রাণ-প্রকৃতি

আইনুন নিশাত
আইনুন নিশাত
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৫২ | আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৪ | ১০:৪৮
বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে। এর ফলে স্বল্পমেয়াদি ভিত্তিতে আবহাওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে জলবায়ুর ওপর বহু ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। গবেষকরা দেখিয়েছেন, এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ইতোমধ্যে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, পৃথিবীর সব দেশই বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মাত্রা হিসেবে বোধ করি বাংলাদেশ সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ বাড়বে। একই সঙ্গে খরার প্রকোপ বাড়বে; উপকূলীয় অঞ্চলে সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের প্রাদুর্ভাব বাড়বে; সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধির কারণে লবণাক্ত পানি দেশের ভেতর প্রবেশ করবে; বৃষ্টিপাতের সময়টা অনিশ্চিত হবে এবং গরম বাতাসের হল্কা আরও বেশি অনুভূত হবে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর চাপ বাড়বে; সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে; স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; দারিদ্র্য বাড়বে; প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের জীবিকা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
ইতোমধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলো মোকাবিলায় ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান বা জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বলা হচ্ছে, এ জন্য কমিউনিটি বেজ্ড অ্যাডাপ্টেশন বা সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অভিযোজন, ইকোসিস্টেম বেজ্ড অ্যাডাপ্টেশন বা প্রতিবেশসম্মত অভিযোজন এবং নেচার বেজ্ড সল্যুশন বা পরিবেশভিত্তিক অভিযোজন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে অনেক এলাকাকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া বা প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকারূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এসব এলাকা জীববৈচিত্র্যের বিবেচনায় খুব সমৃদ্ধ কিন্তু জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে এসব এলাকায় এবং এর ওপর নির্ভরশীল জনমানুষের জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ‘নবপল্লব’ (নেচার বেজ্ড অ্যাডাপ্টেশন টুওয়ার্ডস প্রস্পেরাস অ্যান্ড অ্যাডেপ্ট লাইভস অ্যান্ড লাইভলিহুডস ইন বাংলাদেশ) শীর্ষক একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।
আজ পহেলা এপ্রিল, ২০২৪; হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আনুষ্ঠানিকভাবে নবপল্লব প্রকল্পের জাতীয় পর্যায়ে যাত্রা শুরু হচ্ছে। প্রকল্পটি ব্রিটিশ সরকারের ‘ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) প্রযোজিত বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (বিসিইপি) অর্থায়নে পরিচালিত হবে।
কেয়ার বাংলাদেশের নেতৃত্বে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশিসহ মোট ৯টি সংস্থা কাজ করবে। সহযোগী সংস্থাগুলো হচ্ছে– সিএনআরএস, কর্ডএইড, সিথ্রিইআর-ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র (ডিএসকে), ফ্রেন্ডশিপ, হিউম্যানিটি অ্যান্ড ইনক্লিউশন (এইচআই), আইডিই ও প্র্যাকটিক্যাল আ্যকশন।
সুন্দরবন এবং হাকালুকি হাওর– এ দুটি এলাকাকে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করেছে। নবপল্লব প্রকল্পের লক্ষ্য হবে এ দুটি এলাকা এবং এলাকা দুটির ওপর নির্ভরশীল কাছাকাছি এলাকার জনসাধারণকে কেন্দ্র করে প্রকৃতিসম্মত অভিযোজন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় নাগরিকদের সহযোগিতায় এ দুটি এলাকায় দুটি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। স্থানীয় জনসাধারণ এ দুটি জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকার ওপর নির্ভরশীল। তাদের এই নির্ভরতা কমাতে এবং পরিবেশসম্মত সম্পদ আহরণ বিষয়ে সুশিক্ষিত করে তোলা হবে। উপকারভোগীদের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুপেয় পানির প্রাপ্যতা
ওই এলাকার জনসাধারণের জন্য বিশেষ সমস্যা। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এ সমস্যার সুরাহা করা হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, তাদের জীবিকার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারলেই তারা পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে উৎসাহী হবে। এলাকা দুটিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়ার কাজটি পর্যালোচনা করে তাকে জনসাধারণের ব্যবহার উপযোগী করা হবে।
আশা করা যায়, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সমাপ্ত হলে প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ প্রক্রিয়া বিজ্ঞান ও পরিবেশসম্মত হবে; প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তাদের দক্ষতা বাড়বে; খাবার পানির প্রাপ্যতা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থায় তাদের জন্য উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে।
এ প্রকল্পের আরেকটি বিশেষ দিক হলো, প্রকল্প পরিচালনায় উপকারভোগীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা সুচারুরূপে সংরক্ষণ করা হবে।
ড. আইনুন নিশাত: প্রফেসর ইমেরিটাস, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সিথ্রিইআর), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- পরিবেশ
- তাপমাত্রা
- বৈশ্বিক উষ্ণতা