ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

স্থানিক পরিকল্পনা যে জন্য জরুরি

উন্নয়ন

স্থানিক পরিকল্পনা যে জন্য জরুরি

সিকদার আনোয়ার

সিকদার আনোয়ার

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৪ | ০৯:৫৬

স্থানিক পরিকল্পনা (স্পেশ্যাল প্ল্যানিং) সামগ্রিক, যেখানে ভৌত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক; এককথায় সামষ্টিক অঞ্চল/বিষয়ে করা হয়। স্থানিক পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ভূমি ব্যবহার, অবকাঠামো নির্মাণ, আবাসন, ট্রাফিক, ল্যান্ডস্কেপ, গ্রামীণ, শহুরে, আঞ্চলিক, পরিবহন, পরিবেশগত পরিকল্পনা এবং আইনি কাঠামো। স্থানিক পরিকল্পনা কোয়ার্টার থেকে শুরু করে গ্রাম, শহর, অঞ্চল, রাজ্য, স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয়, এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে বিস্তৃত। এককথায় স্থানিক পরিকল্পনা হচ্ছে সামগ্রিক পরিকল্পনাভিত্তিক সুষম, টেকসই এবং স্মার্ট উন্নয়ন। পরিতাপের বিষয় এই, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের দেশে অদ্যাবধি অনেকটাই অনালোচিত ও উপেক্ষিত।

বাংলাদেশের নগরায়ণ বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। আর এ নগরায়ণ মূলত অপরিকল্পিত, স্বেচ্ছাধীন, অনিয়ন্ত্রিত; অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক অপরিকল্পিত সমাধানভিত্তিক। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলো যেমন অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে, তেমনি মাঝারি ও ছোট শহরগুলো প্রয়োজনীয় পরিকল্পনার অভাবে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। শহরগুলোর পরিকল্পনায় নাগরিক সুবিধা তৈরি করার জন্য পরিকল্পনার সূচক অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মানসম্মত আবাসন, বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, পার্ক, ফুটপাত, সড়কসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা তৈরি হচ্ছে না; সেখানে মানসম্মত আধুনিক জীবনযাপনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না এবং সেখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হচ্ছে মারাত্মকভাবে। পরিবেশ বিপর্যয় বিশেষ করে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ ইত্যাদি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তা ছাড়া জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বিঘ্নিত এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে যত্রতত্র কৃষিজমি অপরিকল্পিতভাবে বাসগৃহ, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অকৃষি খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে আবাদযোগ্য কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে।

স্থানিক পরিকল্পনা তথা সমগ্র দেশের সার্বিক পরিকল্পনা ব্যতিরেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে নানাবিধ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা এজেন্সির (ইপিএ) ২৩ জানুয়ারি ২০২২-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তাতে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯তম স্থানে নেমে এসেছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’-এর ‘বিশ্বের বায়ুর মান প্রতিবেদন-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ১১৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম, যদিও ২০২২ সালে অবস্থান ছিল পঞ্চম স্থানে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬’ নামক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। প্রতিবেদনে জাতীয় পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্থাটির সর্বশেষ ২০২০ সালের প্রতিবেদনে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বাধিক বন্যা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ১১ শতাংশ জনসংখ্যা বন্যাকবলিত হবে বলে জানানো হয়েছে। 

এদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নিবন্ধনহীন যানবাহনের কারণে যানজট ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, ২০২২ সালে ঢাকার সড়কে প্রতিদিন ৮০ লাখের বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে, যা ২০১৭ সালে ছিল দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। যানজটের কারণে প্রতিদিন যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, তার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। তা ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি থেমে থাকলে রাস্তার আয়ু ১৮-৩০ শতাংশ কমে যায়। এ ছাড়া ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শুধু ঢাকার যানজটের কারণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ২ দশমিক ৯ শতাংশ।

জল নিষ্কাশনের সুযোগবিহীন গ্রামীণ রাস্তাঘাট নির্মাণ, খাল-বিল ভরাট করে রাস্তাঘাট নির্মাণ, অপরিকল্পিত রাস্তার অ্যালাইনমেন্ট, অপ্রয়োজনীয় গ্রামীণ রাস্তা নির্মাণের ফলে গ্রামীণ জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এবং দেশের অনেক নিম্নাঞ্চলে বর্ষার পানিপ্রবাহ হ্রাস তথা পলিমাটির অবর্তমানে কৃষিজমির স্বাভাবিক উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। খাল-বিল, নদী-নালা ক্রমশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নৌ-চলাচল এবং পণ্য পরিবহন দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, পরিবেশ দূষণ, অনিরাপদ খাদ্যসহ স্বাস্থ্যসেবার অন্যান্য বিষয়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। গ্লোবাল হেল্‌থ সিকিউরিটি সূচকে বাংলাদেশ ২০২৩ সালে ১৯৫টি দেশের মধ্যে ৬৭ দশমিক ৪ পয়েন্ট পেয়ে ৮৫  র‍্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান করেছে।  

বিভিন্ন সংস্থা প্রণীত পরিকল্পনা সামগ্রিক না হয়ে এলাকা, প্রকল্প বা ইস্যুভিত্তিক হচ্ছে। ফলে কোনো একটি অবকাঠামোর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণ না করে যত্রতত্র স্থাপনের ফলে সেসব অবকাঠামোর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কমিটমেন্ট, সক্ষমতা এবং দায়বদ্ধতার অভাব যেমন পরিলক্ষিত হয়, তেমনি পরিকল্পিত উন্নয়নের একটি স্থায়ী ও নির্দিষ্ট বাস্তবায়ন যন্ত্রের অভাব ভীষণভাবে পরিলক্ষিত হয়।  

দেশের ভৌগোলিক অবস্থা, নদ-নদী, পাহাড়, সমতল ভূমি, হাওর-বাঁওড়, সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য এবং বিবেচনায় রেখে সমগ্র দেশের জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র দেশের জন্য অঞ্চলভিত্তিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। তা ছাড়া বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং অন্যান্য শহরে সুষ্ঠু ভূমি ব্যবহার পরিচালনা ও নিশ্চিতে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা জরুরি। অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শী উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট নানাবিধ বিপর্যয়, দুর্ঘটনা, জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত হওয়া এবং অন্যান্য কুফল সম্পর্কে সাধারণ্যে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে পরিকল্পিত উন্নয়নের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ছাড়া স্থানিক পরিকল্পনার ওপর বিভিন্ন অংশীজনের করণীয় নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে স্থানিক পরিকল্পনা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। 

সরকারের ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী, উন্নত, স্মার্ট দেশ গড়ার রূপকল্প বাস্তবায়নে স্থানিক পরিকল্পনার ওপর সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো গঠন, বিদ্যমান আইনি বিধিবিধান প্রতিপালন ও অনুসরণ, ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রতিরোধ, উন্নত ও মানসম্মত জীবনব্যবস্থা সুসংহতকরণ ইত্যাদির বিকল্প নেই। উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদদের মেধা, পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো, স্মার্ট শহর বা স্মার্ট দেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে, যা বাস্তবায়নে জনবল, সিস্টেম, উন্নয়নযন্ত্রকেও স্মার্ট করতে হবে। সর্বোপরি উন্নয়ন হতে হবে পরিকল্পিত ও দূরদর্শী। সারাদেশের নগরায়ণকে পরিকল্পনামাফিক সাজাতে এবং সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ নগরায়ন নিশ্চিত করতে সমগ্র দেশের স্থানিক পরিকল্পনা তথা সামগ্রিক জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।

বিদ্যমান বাস্তবতায় সমগ্র দেশের স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ নগরায়ণ ও গ্রামীণ ব্যবস্থাকে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে সমর্থ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।

সিকদার আনোয়ার: কলাম লেখক, 
সাবেক সচিব

 

আরও পড়ুন

×