ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

দায়িত্বহীনতার বিশাল সুড়ঙ্গ

উচ্চারণের বিপরীতে

দায়িত্বহীনতার বিশাল সুড়ঙ্গ

মাহবুব আজীজ

মাহবুব আজীজ

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ২২:০৯

রাজধানীসহ সারাদেশে তীব্র তাপদাহে জীবন বিপর্যস্ত। গত ৭৬ বছরের মধ্যে টানা এতদিন ধরে তাপ্রবাহ চলেনি। পরিবেশগত বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই দুরবস্থা। এর পেছনে নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতা যেমন; সমষ্টিগত স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্যও তেমনই দায়ী। উন্নয়নের নামে নির্বিচারে গাছ কাটা ও নদী ভরাটের মধ্য দিয়ে গত দুই দশকে দেশজুড়ে পরিবেশ-বিনাশী তাণ্ডব চালানো হয়েছে। ছায়াময়ী ও প্রাণদায়িনী হতে যে গাছটির কমপক্ষে ২০ বছর সময় লাগে, রাস্তা বা সড়ক বিভাজিকা নির্মাণের নামে সেটাকে এক দিনে কেটে ফেলা হয়! আর ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত। জলাভূমি ভরাট করে গড়ে উঠছে আবাসন ব্যবসা। তবে এতসব ঘটনা এক দিনে ঘটে না। চোখের সামনেই তিলে তিলে গড়ে ওঠে অনৈতিকতার পাহাড়। এর কোনো কোনোটি আকস্মিকভাবে বিস্ফারিত হয়ে নিরপরাধ, নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়।

বেইলি রোডে আগুনে ভস্মীভূত গ্রিন কোজি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো আরও একবার মনে পড়ছিল দিন দুয়েক আগে। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের দিকে এগিয়েছে। চারপাশে আলো জ্বলে উঠলেও একসময়ের ঝলমলে গ্রিন কোজি অন্ধকার, গা ছমছমে ভস্মীভূত অবয়বে বিধ্বস্ত-দাঁড়িয়ে।

তদন্ত কমিটির তথ্যমতে প্রায় দু’মাস আগে ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ভবনের নিচতলায় চা দোকান থেকে আগুনের যে সূচনা, তা দোতলার কাচ্চিভাই রেস্টুরেন্টের ৮/১০টি চুলা ও সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে মহাধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুরো ভবনে অন্তত ৪৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। দু’মাস পরের সন্ধ্যায় দেখি, ভবনটির চারদিক ঘিরে পুলিশের ‘ক্রাইম জোন’ ব্যারিকেড; দুর্ঘটনার রাতের শেষ পর্যায়ে যে অবস্থায় ছিল ভবনটি, আজও তাই আছে। কাচের টুকরাগুলো সেইভাবে ছড়ানো, নিচের তলার চায়ের দোকান ও মোবাইলের দোকান একই রকম ধ্বস্ত, দোতলার কাচ্চিভাই রেস্টুরেন্ট নিথর। আশপাশের ভবনগুলো অবশ্য প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সারি সারি ভবনে আগের মতোই আলোকোজ্জ্বল রেস্টুরেন্টের ভিড়। 

ফেব্রুয়ারির শেষ দিন বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির পর ৩ ও ৪ মার্চ শুরু হয় ডিএমপি, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অভিযান। রাজধানীজুড়ে শত শত রেস্তোরাঁ ও ভবনে সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীন অভিযানের সমালোচনাও হয় যথেষ্ট। কিন্তু বহুতল ভবনে অনুমতিহীন গুচ্ছের চুলা ও গ্যাস সিলিন্ডারের ঢিপি বসিয়ে ভবনটিকে রীতিমতো অগ্নিকুণ্ড বানিয়ে যারা অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল, তাদের বা ভবন মালিকের বিরুদ্ধে আদৌ শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল কিনা আমরা জানি না। আমরা জানি না, তাদের আদৌ অভিযুক্ত করা হয়েছিল কিনা। 
আর এখন? বেইলি রোডের সেই রাস্তায় সিলগালা করা নবাবী ভোজসহ সবক’টি বন্ধ রেস্টুরেন্ট আবার চালু হয়েছে। নবাবী ভোজের ম্যানেজার জানান, ৫ মার্চ তাদের রেস্টুরেন্ট সিলগালা করে সিটি করপোরেশন। এক মাস পাঁচ দিন পর ১৮ এপ্রিল আবার আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সনদ পায়। অন্যান্য রেস্টুরেন্টের অনেকেই জানান, তারা যাবতীয় আইন মেনে ব্যবসা করছেন। ভবনে চুলার গুচ্ছ? সিলিন্ডার? না, তারা আর ভবনের ওপরের দিকে সিলিন্ডার রাখছেন না জানিয়ে বলেন, চুলার সংখ্যাও তাদের প্রত্যেকেরই বেশ কম।

ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন, প্রয়োজনীয় উপকরণ যথাযথভাবে ব্যবহার করবেন; আর এসবই নিয়মিত পরিদর্শন করবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ। এটাই আইনের শাসনের মৌল পাঠ। পুলিশ, সিটি করপোরেশন, ফায়ার ব্রিগেড, রাজউক– ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের ঘটনা ঘটার পরপর যে পরিমাণে তৎপর ছিল, বর্তমানে রাজধানীর রেস্টুরেন্ট নিয়ে তাদের তৎপরতার খবর কী? 

২.
সিটি করপোরেশনের তৎপরতাও সন্তোষজনক নয়। এই কলামেই বেইলি রোডের কাচ্চিভাই রেস্টুরেন্টে অগ্নিকাণ্ডের পর উত্তরার ২৮ নম্বর সোনারগাঁও জনপথের ছয়তলা আবাসিক ভবনের পাঁচতলায় একই ব্র্যান্ডের রেস্তোরাঁর সরেজমিন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলাম। সেখানে আটটি চুলায় একযোগে কাচ্চি বানানো চলে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি নেই; তবু নিচতলার গ্যারেজে ৯টি দোকান। সরকারি সংস্থাগুলোর নাকের ডগায় আট চুলা বসিয়ে আবাসিক ভবনে চলে রেস্তোরাঁ। ১৪ মার্চ রাজউকের পরিদর্শন দল এসেছিল উত্তরা সোনারগাঁও জনপথের এই ভবনে। তারা জিলাপির দোকানে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে, ছাদের একটি রেস্টুরেন্ট সিলগালা করে; তবে কাচ্চিভাইয়ের আট চুলা চোখে পড়েনি। এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত দেড় মাসেও পড়েনি। আতঙ্কগ্রস্ত ভবনবাসী প্রায়ই রাজউকে তাদের উদ্বেগের কথা জানান; তবে দাপুটে লোকজনের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে রাজউকও ‘সাধারণ’ সময়ে এ ধরনের অভিযোগ আমলে নেয় না।
‘সাধারণ’ সময়? সাড়াজাগানো দুর্ঘটনার রেশ যখন চাপা পড়ে যায়, সেই সময়টাই সাধারণ সময়। তখন পুলিশ, সিটি করপোরেশন, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস– কাউকেই এসব ঘটনায় বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় না। 

৩.
নিরুদ্বেগ কর্মকর্তাদের ঔদাসীন্যে একের পর এক প্রাণহানি ঘটিয়ে চলছে সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়ির চাকা। মতিঝিল সরকারি আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহিন আহমেদকে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাক চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। ১৩ বছরের কিশোর মাহিনের জানাজায় অংশ নিয়ে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত চালক গাড়িটি চালাচ্ছিল না। অন্যকে ভাড়া খাটানোর জন্য দেওয়া হয়েছে। এটা বরদাশত করব না। কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এর আগে সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়িচাপায় তিন বছরে অন্তত ১৩ প্রাণহানি ঘটেছে। সমকাল জানাচ্ছে, ‘অনেক ক্ষেত্রেই মূল চালকের বদলে হেলপার বা বদলি চালক গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এসব দুর্ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।’ (সমকাল, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪)। 
মাহিন হত্যার বিচার হবে? পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, হবে না। রেস্টুরেন্টে আগুনে পুড়ে মৃত্যু, ময়লার ট্রাকে চাপা পড়ে মৃত্যু, সড়কে বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু, উঁচু ভবন থেকে ইট মাথায় পড়ে মৃত্যু, নির্মীয়মাণ ওভারব্রিজের অংশ আকস্মিক পথচারীর মাথায় পড়ে মৃত্যু– একটিরও দায় কেউ নেয়নি, নেয় না। পুলিশ, সিটি করপোরেশন, রাজউক, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে যদি দুর্ঘটনার পর গতিশীল না হয়ে সর্বদা নিয়ম মেনে নিজেদের কাজের জবাবদিহি করে, তাহলে এ ধরনের প্রাণহানি নিশ্চিতভাবে কমে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরপর কয়েক দিন সংবাদমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সরব ও সজাগ থাকলেও আরেকটি দুর্ঘটনা এসে মনোযোগ সরিয়ে নেয়। সমস্যা যে তিমিরে থাকে, সেখানেই রয়ে যায়।
দায়িত্ব যার যেটি, তাকে সেটি তাই সবার আগে পালন করতে হবে। পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহি থাকলে সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাক কিশোর মাহিনকে পিষে ফেলতে পারে না। যার গাড়ি চালানোর কথা নয়, কেন সে গাড়ি চালাচ্ছিল? এই বেআইনি কাজ তদারকি নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্টভাবে কারও দায়িত্ব। দায়িত্বে অবহেলার জন্য তারা কেন বিচারের আওতায় আসবে না? একের পর এক প্রাণহানির দায় কাউকেই নিতে হয় না, এটি কীভাবে সম্ভব হয়; দায়িত্বহীনতার এই পরম্পরার মূল গ্রন্থিমুখ সন্ধান তাই জরুরি। 
রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে দায়িত্বহীনতার বিশাল সুড়ঙ্গ। প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহি ও সুশাসন এর উত্তর। আর কিছু নয়। 

মাহবুব আজীজ: সাহিত্যিক; উপসম্পাদক, সমকাল
[email protected]\

আরও পড়ুন

×