শাপলা চত্বরের ষড়যন্ত্র যেভাবে মোকাবিলা করেছিলাম
ফিরে দেখা

একেএম শহীদুল হক
একেএম শহীদুল হক
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪ | ২৩:৪৭
ইতোমধ্যে ১১ বছর কেটে গেছে। কিন্তু ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম যে ষড়যন্ত্রমূলক সমাবেশ করেছিল, যেভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে এবং সমাবেশ ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর যে অপপ্রচার করেছে, দেশের রাজনীতিতে তার প্রাসঙ্গিকতা এখনও ফিকে হয়ে যায়নি। তৎকালীন অ্যাডিশনাল আইজিপি (প্রশাসন ও অপারেশন) তথা বাংলাদেশ পুলিশের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ওই ঘটনা আমি কাছ থেকে দেখেছিলাম এবং হেফাজতের তাণ্ডব ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলাম।
অনেকে জানেন, হেফাজতে ইসলাম ২০১১ সাল থেকেই জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। তাদের আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল সমর্থন দেয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তারা সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি পেশ করে।
দাবি আদায়ে বিভিন্ন কর্মসূচির এক পর্যায়ে তারা ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধের ডাক দেয়। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের প্রতিশ্রুতিতে মহানগরীর ছয় প্রবেশপথে অবস্থানের অনুমতি পায়। কিন্তু সেখান থেকেই হঠাৎ তারা নতুন কর্মসূচি দিয়ে বলে যে, বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সভা করবে।
অ্যাডিশনাল আইজিপি হিসেবে তখন আমি গোটা দেশের পরিস্থিতিতে নজর রাখতাম, খোঁজখবর নিতাম এবং ইউনিটপ্রধানদের প্রয়োজনীয় উপদেশ-নির্দেশ দিতাম। চিন্তিত হয়ে পড়লাম যে, ডিএমপি কমিশনার প্রায় সব অফিসার ও ফোর্স ঢাকার ছয় প্রবেশপথে মোতায়েন করেছেন। হেফাজত নেতাকর্মীকে মহানগরের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।
খবর পেলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাদের ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি দিতে বলেছেন। সাহস করে সরাসরি ফোন করে তাঁকে বলার চেষ্টা করলাম, ওদের উদ্দেশ্য ভালো না। ডিএমপির কাছেও এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত ফোর্স নেই। তিনি বললেন, ‘তোমরা খামাখা ভয় পাচ্ছো। সভা শেষে হুজুর দোয়া করে চলে যাবেন। সমস্যা নেই।’ আমি কথা বাড়াতে সাহস পেলাম না।
অনুমতি দিল ডিএমপি; তবে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে নয়, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। শর্ত, বিকেল ৫টার মধ্যে সভা শেষ করে চলে যেতে হবে। কিন্তু অনুমতি পেয়ে ছয়টি প্রবেশপথ থেকে হেফাজতের অধিকাংশ মিছিল শাপলা চত্বরের বদলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে যেতে চাচ্ছিল। শাপলা চত্বরের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইলে তারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সড়ক বিভাজকের গাছপালা কেটে ফেলে, সড়কের দু’পাশে ও ফুটপাতের দোকান, পার্ক করা গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ওদিকে শাপলা চত্বরে নেতারা উগ্র বক্তৃতা দিয়ে উত্তেজনা ছড়াতে থাকেন।
হেফাজতের আমির মাওলানা আহমেদ শফি লালবাগ মাদ্রাসায় অবস্থান নেন। কথা ছিল, তিনি শাপলা চত্বরে গিয়ে আসরের নামাজ পড়ে দোয়ার মাধ্যমে সমাবেশ সমাপ্ত ঘোষণা করবেন। এসবির একজন পুলিশ সুপার লালবাগ মাদ্রাসায় অবস্থান নেন। আসরের নামাজ ঘনিয়ে এলে পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি সাড়া দিচ্ছিলেন না। সন্ধ্যার আগে সহকর্মীদের নিয়ে শাপলা চত্বরের উদ্দেশে রওনা হলেও পথিমধ্যে ফোন পেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে লালবাগ ফিরে যান। আর শাপলা চত্বরে অবস্থানরত নেতারা ঘোষণা দেন, তাদের ১৩ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত অবস্থান চলবে।
বুঝতে বাকি রইল না, বিএনপি-জামায়াত ইন্ধন দিচ্ছে হেফাজতকে। বিভিন্ন সূত্র থেকেও একই তথ্য পেলাম। আইজিপি মহোদয় ও আমি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গেলাম। তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ দেখলাম। এক পর্যায়ে র্যাবের ডিজি, বিজিবি কর্মকর্তারাও পুলিশ কন্ট্রোল রুমে এলেন।
আমি প্রথম থেকেই অপারেশনের পক্ষে। ডিসি মতিঝিল, ডিসি ওয়ারী, ডিসি রমনা ও ডিসি লালবাগের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে দেখলাম, তারাও অপারেশনের পক্ষে। কারণ সংবাদ পাচ্ছিলাম, ভোরেই হেফাজত, বিএনপি, জামায়াত মিলে সরকারের পতনের লক্ষ্যে মহানগরীজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে।
এ অবস্থায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করে অপারেশনের পক্ষে সিদ্ধান্ত প্রার্থনা করলাম। বললাম, পুলিশ সতর্কতার সঙ্গে অপারেশন করবে। কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হবে না; সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেলের গ্যাস ও লাঠি, বেশি প্রয়োজন হলে শটগান। সতর্কতার কথা শুনে শীর্ষ মহল কিছুটা নমনীয় হলেন এবং আইজিপিকে আনুষ্ঠানিক নির্দেশ দিলেন। সিদ্ধান্ত হলো, অযথা বল প্রয়োগ হবে না। পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকে শাপলা চত্বর ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হলে ছত্রভঙ্গ জনতার চলে যাওয়ার জন্য পূর্ব ও দক্ষিণ দিক খোলা থাকবে।
রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে একযোগে অপারেশন শুরু হয়। সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যাপক শব্দে এলাকা কেঁপে ওঠে। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে শাপলা চত্বর খালি হয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হেফাজত কর্মীর অধিকাংশ দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ সাহায্য করেছিল। কাউকে গ্রেপ্তার বা আঘাত করেনি।
৫ মে (২০১৩) সারাদিনের সংঘাতে যদিও ঢাকা মহানগরীতে তিন-চারজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়; পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাতের অভিযানে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। বরং দিনের বেলা হেফাজতের তাণ্ডবে কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। ৬ মে সকালবেলা দিলকুশা রোডে একজন সাব-ইন্সপেক্টরের মরদেহ উদ্ধার হয়। অথচ একটি কুচক্রী মহল প্রচার করে, শাপলা চত্বরে শত শত লোককে হত্যা করা হয়েছে।
অপারেশনের দৃশ্য কোনো কোনো টিভি ‘লাইভ’ দেখিয়েছে। সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। কেউ এ ধরনের আজগুবি সংবাদ পরিবেশন করেননি। অথচ কুচক্রী মহল সামাজিক মিডিয়ায় মিথ্যা প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল। কিছুদিন পর আইজিপির অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত আইজিপি হিসেবে আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে সংবাদ সম্মেলন করে মিথ্যা ও অপপ্রচারের জবাব দিই। আমরা চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম, ৫ মে দিবাগত রাতে শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযানে কারও প্রাণহানি ঘটেনি। যদি হয়ে থাকে, হেফাজতে ইসলাম তাদের নাম-ঠিকানা দিক। কিন্তু গত ১১ বছরেও তারা কোনো তালিকা দিতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে আরও স্পষ্ট হয়, বিএনপি-জামায়াতের নীলনকশায় হেফাজতের একটি অংশ ৫ মে তাণ্ডব ঘটিয়েছিল। সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতেও স্বীকার করেন যে, বিএনপি-জামায়াতপন্থিদের দৌরাত্ম্যেই অঘটন ঘটেছিল। আহমেদ শফিপন্থি আলেমরা অসহায় ছিলেন।
একেএম শহীদুল হক: সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ
- বিষয় :
- ফিরে দেখা