মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
নিজে তদন্ত এবং অভিযোগের প্রমাণ দাবি করতে হবে

এম এম আকাশ
এম এম আকাশ
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৪ | ০০:০৭ | আপডেট: ২৩ মে ২০২৪ | ১৭:১৪
মঙ্গলবার সকাল থেকেই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম সরগরম হয়ে উঠেছিল। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্থানীয় সময় সোমবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তাঁর পরিবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর ফলে তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস আইনের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায় এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
আমরা দেখছি, বাইডেন প্রশাসন যদিও আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর’ দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে; এখন পর্যন্ত তারা সেই দুর্নীতির বিস্তারিত খোলাসা করেনি। আমি মনে করি, একটা দেশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলে রাষ্ট্রীয়ভাবেই তার প্রমাণ দাখিল করা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য যে কোনো দেশ; সবার ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।
এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের সোমবার প্রদত্ত বিবৃতিতে দুর্নীতির কিছু ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ওই বিবৃতির এক পর্যায়ে বলা হয়েছে, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের তৎপরতার কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমের ওপর থেকে জনগণ আস্থা হারিয়েছে। বিষয়টির আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেলে ভালো হতো। বিবৃতিতে না থাকুক; রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কি এগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা হস্তান্তরিত হয়েছে? এ ছাড়া এই প্রশ্নও যৌক্তিক, এগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
একই সঙ্গে ওই বিবৃতিতে তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ও নানা অনিয়মের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। তাদের দাবি, আজিজ আহমেদ ব্যক্তিস্বার্থের বিনিময়ে সরকারি নিয়োগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ ছাড়া বিজিবির মহাপরিচালক ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নিজের প্রভাব খাটিয়ে তাঁর ভাইকে সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পেতে সহযোগিতা করেছিলেন বলেও অভিযোগ তোলা হয়। এসব অভিযোগ নিঃসন্দেহে গুরুতর।
এ ছাড়া তাঁর ভাইয়ের অপরাধ সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচাতে দুর্নীতির আশ্রয় নেন বলে দাবি করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। আমরাও জানি, আজিজ আহমেদের ভাই রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা থেকে রেহাই পেয়েছেন। বিষয়টি যখন নতুন করে সামনে এসেছে, তখন সরকার চাইলে ওই প্রক্রিয়া পুনরায় খতিয়ে দেখতে পারে। এতে আর কিছু না হোক, সত্য প্রতিষ্ঠা হবে।
এরই মধ্যে আজিজ আহমেদ দেশীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনুমিতভাবেই সেখানে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে কেবল তাঁকে হেয় করা হয় না, বরং এ ঘটনা সরকারকেও বিব্রত করে। কেননা, তিনি ভিন্ন ভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় দুটি সামরিক বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। আজিজ আহমেদ অভিযোগ অস্বীকার করতে গিয়ে ২০২১ সালের একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বহুল আলোচিত ঘটনা সামনে নিয়ে আসেন। তিনি বলেছেন, আলজাজিরাও তাঁর বিরুদ্ধে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামে এক তথ্যচিত্র প্রচার করেছিল, যেখানে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধভাবে প্রভাব খাটানোর কথা তুলে ধরা হয়েছিল।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে আলজাজিরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ তথ্যচিত্রটি প্রচার করে। সে সময় দেশে-বিদেশে এ নিয়ে বহু বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তখন আলজাজিরার এই প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা ও অবমাননাকর’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ঘটনার আইনি ব্যবস্থা নেবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে সরকার এ নিয়ে কতদূর এগিয়েছিল, এখন পর্যন্ত দেশবাসীর জানা নেই।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রভাবশালী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এ সময় কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের শীর্ষস্থানীয় তিনজন কর্মকর্তার ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পটিতে ঋণ দেওয়ারও কথা ছিল। বিতর্কের এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে দেয়। এ নিয়ে কানাডার আদালতে দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর শুনানি ও তদন্ত চলে। ২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আদালত এ অভিযোগ খারিজ করে ঘোষণা দেন– পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো ধরনের ঘুষের লেনদেন হয়নি।
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটাও সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিতর্কের মতো তদারকি করে দেখতে পারে। কেননা, এতে দেশের সর্বোচ্চ ভাবমূর্তিও জড়িত হয়ে পড়েছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণেই নয়; বিদেশে দেশের ভাবমূর্তির স্বার্থেও নয়; অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও আইনের শাসনের প্রশ্নেই এগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, এর প্রায় সবই স্পর্শকাতর ইস্যু। যাতে ভবিষ্যতেও এসব ইস্যুতে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে বা কেউ অনিয়ম ও দুর্নীতি করার সুযোগ পেতে না পারে।
আজিজ আহমেদ অভিযোগ অস্বীকার করতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনাও তুলে ধরেছেন, যেগুলো নিয়ে তদন্ত হওয়া জরুরি মনে করি। তা ছাড়া তিনি নিজে বিষয়গুলো সংবাদমাধ্যমে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন। তাঁর জন্যও এগুলো মিথ্যা প্রমাণ হওয়াটা জরুরি।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ নিয়ে দেশের নাগরিক, সরকার ও বিরোধী দলগুলোর পরস্পরবিরোধী মত আছে। কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ ‘ডার্টি লিনেন’ আমরাই পরিষ্কার করতে চাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেখানে নাক গলানো উচিত নয়। তাতে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি বলে প্রতিভাত হয়।
আলজাজিরা কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের সঙ্গে সমগ্র দেশের জাতীয় ভাবমূর্তিও জড়িত। সুতরাং, দেশের প্রধানমন্ত্রীর উচিত ঘটনার মূলে কী আছে বা অভিযোগের সত্যতা কতটুকু, তা জরুরি ভিত্তিতে খতিয়ে দেখা। অন্যদিকে, সুনির্দিষ্ট আইন ও নিয়ম মেনে রাষ্ট্রে সেনাপ্রধান নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা-বাহিনীগুলোর প্রধানদের (নিয়োগ, বেতন, ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধা) আইন, ২০১৮ এর ৪(১) অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কমিশন্ড অফিসারদের মধ্য থেকে বাহিনীপ্রধান পদে নিয়োগদান করিবেন।’ তাহলে এই ঘটনায় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষগুলোও পরোক্ষভাবে দায় এড়াতে পারে না।
তাই যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগগুলো উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। বরং সরকারের পক্ষ থেকে নিজেই তদন্ত করে দুর্নীতি-সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর সত্যাসত্য নির্ধারণ করা উচিত। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে বলে নয়; নিজেদের দেশের স্বার্থেই এসব করতে হবে।
অধ্যাপক এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
- বিষয় :
- রাজনীতি
- মার্কিন নিষেধাজ্ঞা