শান্তিরক্ষী দিবস
সাফল্যের কৃতিত্ব জাতিসংঘের, ব্যর্থতার দায় শান্তিরক্ষীর?

খন্দকার সাইফুল ইসলাম
খন্দকার সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪ | ০০:০৭
জাতিসংঘ আরেকটি শান্তিরক্ষা দিবস উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি সহিংসতা বন্ধ ও যুদ্ধবিরতি তত্ত্বাবধানে ১৯৪৮ সালের ২৯ মে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সামরিক পর্যবেক্ষকদের একটি মধ্যস্থতাকারীর দল অনুমোদন করেছিল, যা ‘ইউনাইটেড নেশনস ট্রুস সুপারভিশন অর্গানাইজেশন’ ইউএনটিএসও হিসেবে পরিচিত। সেই দিনটি স্মরণ করে বিশ্বজুড়ে শান্তিরক্ষীদের অবদান ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৩ সাল থেকে ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
৭৬ বছর আগে বিশ্বের প্রথম শান্তিরক্ষা মিশন সূচিত হয়েছিল মূলত মানবাধিকার হরণ, রক্তপাত ও গণহত্যা রোধে। কিন্তু এ বছর যখন দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে, এগুলো থেমে নেই। এমনকি যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্তমান বিশ্বে জাতিসংঘের নেতৃত্বও প্রশ্নবিদ্ধ। যেহেতু শান্তিরক্ষা কার্যক্রম অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং ইতিবাচকভাবে দৃশ্যমান, তাই অনেকের কাছে শান্তিরক্ষা মিশনই হলো জাতিসংঘ।
যাই হোক, শান্তিরক্ষা মিশনের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ তো নয়ই, বরং সাফল্যের সঙ্গে আত্মত্যাগের পাশাপাশি কিছুটা ব্যর্থতার বদনামও হজম করতে হয়েছে। সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, কঙ্গো, আইভরি কোস্ট ও মোজাম্বিকে শান্তিরক্ষা মিশন প্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছে। শান্তি ও মানবাধিকার পুনরুদ্ধারে প্রশংসনীয় ভূমিকার জন্য সদস্যদের মিলেছে স্বীকৃতি। অন্যদিকে সোমালিয়া, রুয়ান্ডা, অ্যাঙ্গোলা ও বসনিয়ায় শান্তিরক্ষা মিশন বিপর্যয় রোধে ব্যর্থ বলে সমালোচিত হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী ও গৃহযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লিস মর্জ হাওয়ার্ডের মতে, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সচিবালয়ের সাংগঠনিক সমন্বয়হীনতা, নিরাপত্তা পরিষদের প্রবল আগ্রহ বা অনাগ্রহ ছিল এ ধরনের পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।’
এটি জানা কথা, শান্তিরক্ষা মিশন কাজ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে, বৈশ্বিক সংস্থাটির অন্য যে কোনো বিভাগের মতো। ফলে বৃহৎ পরিসরে পরিস্থিতি যা-ই হোক, শান্তিরক্ষা মিশন নেতৃত্ব স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত বা আশু পদক্ষেপ নিতে পারে না; যদিও কার্যক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় সংশ্লিষ্ট মিশনকেই নিতে হয়। শান্তিরক্ষা মিশনের সাফল্য জাতিসংঘ উদযাপন করলেও, দুর্ভাগ্যবশত যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য কর্তব্যরত শান্তিরক্ষীদেরই দোষ দেওয়া হয়, সর্বোচ্চ ত্যাগ
স্বীকার সত্ত্বেও।
ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও জাতিসংঘ ফিলিস্তিনিদের যৌক্তিক অধিকার আদায়ে সক্ষম হয়নি। কাশ্মীর সংকটও অমীমাংসিত; সংকট চলমান দক্ষিণ সুদান, সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন বা মালিতে। অনস্বীকার্য, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের পক্ষপাতমূলক প্রভাবের কারণেই এসব সংকট
দীর্ঘায়িত হয়েছে।
কম্বোডিয়াতে জাতিসংঘ খেমার রুজ শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিণামে প্রায় ২০ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে, যা জাতিসংঘের কৌশলগত ব্যর্থতা হিসেবেই দেখা হয়। সেব্রেনিকাতে বসনিয়ান মুসলমানদের গণহত্যার শিকার হতে হয়েছিল শান্তিরক্ষী বাহিনীর অপর্যাপ্ততার কারণে, যা ইউরোপীয় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা বলে স্বীকৃত। একইভাবে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রুয়ান্ডায় সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার কারণে ১৯৯৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে আট লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যায়।
জাতিসংঘের ইতিহাসে আরেকটি বড় বিপর্যয় ছিল ভয়াবহ গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে– এমন অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণ রোধে ব্যর্থতা। একাধিক তদন্তের পর এটি এখন প্রমাণিত– ইরাকে
ভয়াবহ গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কথা ছিল প্রতারণামূলক অজুহাত।
নিরাপত্তা পরিষদ যে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে নিরুপায়, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রকৃত অর্থে শান্তিরক্ষা মিশন এলাকার জনগণের প্রতি নিরাপত্তা হুমকি বা প্রাণহানির আশঙ্কা থাকলেও শান্তিরক্ষা মিশন নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নিতে পারে না। এ কারণেই শান্তিরক্ষীরা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে, মরছে; তারপরও নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত বা ব্যর্থতার জন্য শান্তিরক্ষীদেরই অনেকাংশে দায়ী করা হচ্ছে।
শান্তিরক্ষীরা যুদ্ধ ও সংঘাতের অশান্ত পরিস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে; সংঘাত সমাধানে আলোচনার পথ প্রশস্ত করছে; বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণ ও সম্পদ রক্ষা করছে এবং নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জরুরি পরিস্থিতিতে মানবিক সহায়তা প্রদান করছে।
১৯৪৮ সাল থেকে ১২০টির বেশি দেশ থেকে ২০ লাখের বেশি পুরুষ ও নারী শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেছেন। এসব মিশনে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ৩০ এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৭৪ জন শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত বিভিন্ন মিশনে ১৩০ জন শান্তিরক্ষী হারিয়েছে। প্রথম শহীদ শান্তিরক্ষী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফয়জুল করিম। তিনি নামিবিয়াতে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের কমান্ডার থাকা অবস্থায় ১৯৮৯ সালে উইন্ডহোকে মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে প্রথম ইরানে প্রেরিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ৭ হাজারের বেশি শান্তিরক্ষী মোতায়েন করেছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।
শান্তিরক্ষা মিশনগুলো মূলত ইউনিফর্মধারী সেনা ও পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। পেশাগত প্রশিক্ষণ ও কাজের ধরনের কারণে ইউনিফর্মধারী নেতৃত্ব বেসামরিক সহকর্মী বা রাজনীতিবিদদের থেকে আলাদা। সামরিক নেতারা যেখানে লক্ষ্য দ্বারা চালিত, তাদের অধীনস্থ সৈন্য ও রসদের জন্য দায়িত্বশীল এবং সুস্পষ্ট নির্দেশের ভিত্তিতেই কর্ম সম্পাদনে আগ্রহী। অন্যদিকে বেসামরিক পেশাজীবীরা অনেকাংশে কূটনীতিক, যা সামরিক বাহিনীর স্বচ্ছ নির্দেশনা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, আসন্ন হুমকি মূল্যায়ন এবং ঝুঁকি প্রশমনের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে। জাতিসংঘ মহাসচিবের দায়িত্বরত অবস্থায় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত দ্যাগ হ্যামারশোল্ড এ জন্যই একবার বলেছিলেন, ‘শান্তি রক্ষা করা সৈনিকের কাজ নয়, তবে শুধু একজন সৈনিক এটি করতে পারে।’
শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্যরা যুদ্ধাবস্থা এবং সংঘাতপূর্ণ এলাকা, দুর্গম স্থান, বৈরী পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তু, যুদ্ধাহত বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তায় কাজ করছেন। নিজেদের নিরাপত্তা, অনেক ক্ষেত্রে জীবন বিপন্ন করেও মাতৃভূমি থেকে অনেক দূরে শান্তির জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের এই ত্যাগ স্বীকৃতি ও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
খন্দকার সাইফুল ইসলাম: উদ্যোক্তা ও উন্নয়নকর্মী; সাবেক সামরিক কর্মকর্তা
[email protected]
- বিষয় :
- শান্তিরক্ষী বাহিনী