জনশক্তি
মালয়েশিয়ার বাজার জটিল করে তুলেছে রাজনীতিকরা

আসিফ মুনীর
আসিফ মুনীর
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৪ | ০১:৫৩ | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪ | ০১:৫৪
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে বেশ জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ১ জুন থেকে বিদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। ফলে দেশটিতে সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিপুল সংখ্যক শ্রমিক পাঠানোর চেষ্টা চালিয়েছে। এতে বিমানবন্দরে শ্রমিকদের বিশাল জটলা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও বিমানের টিকিট না পাওয়ায় ১৭ হাজার কিংবা ততোধিক অভিবাসনপ্রত্যাশী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, যদিও প্রথমদিকে আমরা সংখ্যাটা ৩০ হাজারের মতো বলে শুনেছিলাম। বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) পক্ষ থেকে এ সংখ্যা চার সহস্রাধিক বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। মূলত রিক্রুটিংয়ে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের কাছেই সঠিক তথ্য থাকতে পারে। তবে সংখ্যা যা-ই হোক, এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। শুধু তাই নয়, সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান না হলে তা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে।
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গাফিলতি রয়েছে। দেশটির নিয়োগকর্তাদের কাছে বাংলাদেশিদের সুনাম রয়েছে বলে তাদের চাহিদাও রয়েছে। কিন্তু এই চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। এখানে কিছু অসাধু চক্র জড়িত। এ চক্রে শুধু বাংলাদেশি নয়; মালয়েশিয়ার লোকও জড়িত। এমনকি সে দেশের সরকারেরও এ চক্রে প্রভাব আছে বলে খবর বেরিয়েছে।
ক’দিন আগে আমাদের গণমাধ্যমে এ নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর বেরিয়েছে, যেখানে দেশের অনেক প্রভাবশালী, এমনকি সংসদ সদস্যের নামও উঠে এসেছে। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারক অনেকে এসব অসাধু কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। এর বাইরে অনেক রিক্রুটিং এজেন্সির নামও আমরা সংবাদমাধ্যমের খবরে জেনেছি।
২০১৮ সালে কিংবা এর আগে রিক্রুটিং প্রক্রিয়া শুরুর সময়েও অসাধু চক্রের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম জানা গিয়েছিল। এবারও তাদের যুক্ততার খবর পাওয়া গেছে। আমরা স্পষ্টত দেখছি, তারা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত। অনেক বছর ধরে সমাজে ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের বলয়ে থেকে তারা এসব কাজ করছে। দুঃখজনক হলো, এত খবর বের হওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ এ চক্রের তৎপরতা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
রাষ্ট্রীয় সুষ্ঠু তদারকি না থাকায় এখানে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। একজন অভিবাসনপ্রত্যাশী এজেন্সির হাতে অতিরিক্ত অর্থ তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রায় ক্ষেত্রে হয়রানি, জাল টিকিট কিংবা জাল ভিসা দেওয়ারও প্রমাণ পাওয়া গেছে, যার পুরো দায় এসে পড়ছে রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর। তবে আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগাভাগি হচ্ছে। গ্রামের একজন দালাল থেকে শুরু করে ঢাকার অনুমোদনহীন লোক দেখানো অফিসের মালিকও এই অর্থের ভাগীদার। অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি দপ্তর এজেন্সিগুলোকে লাইসেন্স দিচ্ছে। লাইসেন্স দেওয়ার পর সেগুলো তদারক করার দায়িত্ব সরকারের। সেটি কিন্তু সরকার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারছে না। অথবা দেখা যাচ্ছে, প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা রাজনীতিবিদরাই এসব এজেন্সির মালিক। অনেক এজেন্সির মালিকের সঙ্গে এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির সুসম্পর্ক রয়েছে। তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সরকারি অনেক কর্মকর্তাও আত্মসাৎকৃত এসব অর্থের ভাগ পান। সুনির্দিষ্টভাবে এগুলো প্রমাণ করা কঠিন। কারণ এসব অসাধু কারবার খাতাকলমে হয় না। বাংলাদেশে সুশাসন, স্বচ্ছতার যে অভাব, তাই এ ক্ষেত্রে রয়েছে। এ কারণে সরকার পুরোপুরি এই দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। কেননা, রিক্রুটিং এজেন্সি সরাসরি যুক্ত থাকলেও রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করে তারা কোনো লোক বিদেশে পাঠাতে পারে না।
এই পুরো প্রক্রিয়ার শিকার হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা জমিজমা বিক্রি বা ঋণ করে বিদেশে যেতে চায়। কিন্তু তারা রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, প্রতারক ব্যবসায়ী, সিন্ডিকেটের চক্রে পড়ে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়। এ ঘটনায় দেশের অনেক পরিবার অকল্পনীয়ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অভিবাসনপ্রত্যাশীর ছাড়পত্র, প্রশিক্ষণ গ্রহণ, স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা– সর্বক্ষেত্রে সরকারের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ কারণে পুরো প্রক্রিয়ায় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
বিদেশে একজন ব্যক্তি কাজ পাচ্ছেন কিনা, সেটাও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দেখার দায়িত্ব। দূতাবাসে ফোন করে কোনো ধরনের সাড়া পাওয়া যায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। হয়তো কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে ফোন ধরা সম্ভব হয় না। কিন্তু সব শেষে একজন সাধারণ নাগরিককেই ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
মোট কথা, রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশগামী শ্রকিদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে বটে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করে একটা এজেন্সি বিমানবন্দর অতিক্রম করে একজন লোক বিদেশে পাঠাতে পারে না। সে জায়গায় সরকারের ক্ষমতা ও এখতিয়ার সবার ঊর্ধ্বে। এ ক্ষেত্রে সরকার তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না বলেই এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এ কারণে সরকার এত কিছু জানার পরও অভিযুক্তদের জবাবদিহির মুখোমুখি করবে কিনা, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। এটা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আরও যা দুঃখজনক, জবাবদিহির মুখোমুখি হলেও এমন অবস্থা তৈরি করা হবে, যেখানে ওই গ্রামের দালালকেই প্রধানত দায়ী করা হবে; প্রভাবশালীদের নয়।
পুরো ঘটনার স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হওয়া দরকার। যারা যেতে পারেননি তাদের সমস্যাও নিরসন করা জরুরি। তবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানই সবচেয়ে জরুরি। এটা করতে না পারলে একই ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে। হয়তো ভবিষ্যতে মালয়েশিয়ায় কোনো জনশক্তি পাঠানোই সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে সমস্যার সমাধান নিঃসন্দেহে সম্ভব।
আসিফ মুনীর: অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ
- বিষয় :
- জনশক্তি রপ্তানি