পাকিস্তান
‘নতুন মিডিয়া’ জগতের পেশাদারিত্ব দেখার কেউ নেই

নতুন মিডিয়া
এম নাদিম নাদির
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৪ | ১৮:৪৪ | আপডেট: ২০ জুন ২০২৪ | ১৯:০৭
শিশুদের স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে একজন মাইক্রোফোন হাতে আমার মন্তব্য চাইলেন। মাইক্রোফোনটি তাঁর সেলফোনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, যার ক্যামেরা দিয়ে তিনি ভিডিও রেকর্ড করছিলেন। আমি তখন এ ধরনের অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রায় দুই মিনিট কথা বলি। তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন। পুরো সাক্ষাৎকার ইংরেজিতে ছিল। কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এসে বললেন, সামাজিক মাধ্যমে তিনি উর্দুতে রিপোর্ট করেন। অনুরোধ জানালেন একই বক্তব্য এবার উর্দুতে দিতে! আমি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আমাদের সময়। হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে রহিম, করিম অনেকে নিজেকে ‘মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব’ বলে দাবি করছেন। তারা হয়তো অনিবন্ধিত চ্যানেলের রিপোর্টার
কিংবা সামাজিক মাধ্যমে নিজস্ব ভিডিও প্রচার করেন। আবার কেউ কেউ শুধু অনলাইনে চালু স্থানীয় কিছু সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন।
এ রকম অনেকের সাংবাদিকতার নীতি সম্পর্কিত পর্যাপ্ত জ্ঞান, এমনকি সাংবাদিকতায় জরুরি ভাষাগত দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে। বলা যায়, যে কোনো বিষয়ের নির্ভুলতা, সততা ও বস্তুনিষ্ঠতাকে অগ্রাহ্য করে তথ্যের গতানুগতিকতা ও সাধারণীকরণের ওপর জোর দেন তারা। মিশেল ঘটান কিছু লোকরঞ্জনের। চলতি ধারার ‘মিডিয়া’ প্রযুক্তিগতভাবে তাদের যেভাবে ক্ষমতায়ন করেছে, তার মাধ্যমে এ রকম ‘সংবাদ ভাষ্যকার’ ও ‘প্রতিবেদক’ সমাজে প্রাধান্য লাভ করে চলেছেন।
চারদিকে এখন অনেক স্বঘোষিত ‘মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব’। মাইক্রোফোন হাতে আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তাও তারা অনেক সময় লঙ্ঘন করছেন। কখনও কখনও তারা ‘ব্ল্যাকমেইল’ করেন। অন্তত সে রকম অভিযোগ আছে সমাজে। এসব পরিচালিত হয় ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ নামেই। এ ধরনের সাংবাদিকতার ইতিবাচক নজিরও বিপুল, যেখানে নাগরিক কর্তব্যবোধের সঙ্গে বাস্তবিক রিপোর্টিং ক্ষমতা মিশে শক্তিশালী একটি ধারা তৈরি হয়েছে। মুশকিল হলো, কেউ এ রকম মিডিয়া-ব্যক্তিত্বদের কাছে প্রমাণপত্র চান না।
স্ব-দাবিকৃত সাংবাদিকের অনেকে সামাজিক খ্যাতি অর্জনের খণ্ডকালীন শখ হিসেবে কাজে নেমেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জীবনের অন্যদিকে হয়তো কৃতকার্য হতে পারছিলেন না; কেউ কেউ বেসরকারি অন্য কোনো পেশায়ও আছেন; কেউ আবার এটাকে ছোট ব্যবসা হিসেবেও নিয়েছেন।
সম্ভবত এটি ‘পোস্ট-ট্রুথ’ বা সত্যোত্তর সময়ে মিডিয়া জগতেরই একটা লক্ষণ, যখন আসল থেকে নকল বেশি শক্তিশালী। অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের চেয়ে প্রমাণ ও ভিত্তি কম থাকা আবেগ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অনুভূতি-মতাদর্শের গুরুত্ব ও আবেদন বেশি হয়ে পড়ছে। স্থানীয় অনেক সংবাদপত্র ও কেবল চ্যানেল খুব সহজে প্রেসকার্ড আকারে এ রকম কর্মীর সহায়তা দিতে পারে এবং দেয়ও। কিংবা সেই সহায়তারও দরকার পড়ছে না। অথচ একই রকম কাজের জন্য কোনো জাতীয় দৈনিক বা জাতীয় চ্যানেলে যুক্ত হতে যে কাউকে দক্ষতার একটি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়। জাতীয় সংবাদপত্রে সংবাদ আইটেম তৈরি, মতামত বা ফিচার-নিবন্ধ যারা লিখছেন বা বলছেন, তাদের অনেক সতর্কতা ও চাপে কাজ করতে হয় এবং তাদের জন্য সামাজিক স্বীকৃতিও অঢেল নয়, যে রকমটা পান ‘কাগজে’র বাইরের বিশাল যোগাযোগ জগতের ‘ব্যক্তিত্ব’রা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এ অবস্থার ভবিষ্যৎ কী? জাতীয় পর্যায়ে ‘অভিভাবক’ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নতুন সময়ের উপরোক্ত ‘মিডিয়া’ গোষ্ঠীকে পরিণত করে তোলায় নজর দিতে হবে।
‘প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর’ শিরোনাম নিয়ে সাংবাদিকতার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নষ্ট করার অবকাশ নেই। নতুন ও স্বতঃস্ফূর্ত কর্মীদের নানাভাবে প্রশিক্ষিত করা যায়। ন্যূনতম পেশাদারিত্বের মানদণ্ডকে বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবা জরুরি।
যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের উদ্দেশ্য হয় রাতারাতি অর্থ ও খ্যাতি অর্জন এবং বাস্তবেও যদি তার সত্যতা মিলে, তাহলে কাজের খোঁজে অনেক তরুণ-তরুণী ইউটিউব চ্যানেল, ব্লগ ও ফ্রিল্যান্স পোর্টাল খোলার প্রতি আকৃষ্ট হবে। সীমিত জ্ঞান ও প্রাথমিক পর্যায়ের ডিজিটাল দক্ষতার ওপর ভরসা করে অনেকে ইতোমধ্যে এ পথে এগোচ্ছেও।
প্রিন্ট মিডিয়াতে যখন অনেক ভালো লেখাও প্রকাশ হওয়ার প্রতিযোগিতায় থাকে; ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নতুনদের প্রবেশ যখন বেশ কঠিন, তখন এসবে আগ্রহী নবীনদের মাঝে নিরুৎসাহ কাজ করে। তারা নিশ্চয় বিকল্প পথ খুঁজবে। কিন্তু সৃজনশীল লেখক হওয়া সহজ কাজ নয়। আবার জনসাধারণকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়া অনেক বেশি। ফলে সৃজনশীলরা তাদের পরিশ্রমের বড় প্রতিদানের খোঁজেও ডিজিটাল জগতের প্রতি মনোযোগী হতেই পারে।
কিন্তু এই মাধ্যমে অপেশাদারিত্ব রোধে স্বকর্মসংস্থানের জন্য তৈরি হওয়া ‘মিডিয়া ব্যক্তিত্ব’দের নিয়ে একটি কর্মকৌশল প্রয়োজন নয় কি? নিশ্চয় ইতিবাচক মনোভাব নিয়েও এটা হতে পারে।
এম নাদিম নাদির: পাকিস্তানের ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর আয়েশা ওয়ারেসা