শুভ জন্মদিন
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: যে বৃক্ষের হৃদয় আছে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
জুবায়ের ইবনে কামাল
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪ | ০০:২৬
বিক্রমপুরের যে অঞ্চলে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জন্ম নিয়েছিলেন, সেখানে পুরুষেরা নাকি বেশি দিন বাঁচে না। পিতা হাফিজ উদ্দিন চৌধুরীর জন্মের আগেই পিতামহ মারা গিয়েছিলেন। যে চাচার কাছে হাফিজ উদ্দিন পালিত হয়েছিলেন, তিনিও বেশি দিন বেঁচে ছিলেন না। পরে যে চাচাতো ভাই তাঁকে দেখাশোনা করতেন, তিনিও মারা গিয়েছিলেন অল্প বয়সে। ম্যালেরিয়া, ওলাওঠার মতো রোগের ছোবল এড়িয়ে হাফিজ উদ্দিন ছিলেন চৌধুরী বংশের প্রথম দীর্ঘায়ু পুরুষ।
সূর্যাস্ত আইনের কাছে পরাজিত ও উদ্বাস্তু হয়ে বিক্রমপুরের এই গ্রামাঞ্চলে এসেছিল চৌধুরীরা। পরিবারটির সঙ্গে উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে এভাবে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজে তিনটি ঐতিহাসিক পর্বে বাস করেছেন; ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তানি শাসনামল, স্বাধীন বাংলাদেশ। একই অঞ্চলের তিনটি ভিন্ন ইতিহাস নির্মাণের সময়ে থেকে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, রাষ্ট্রের চেহারা পরিবর্তন হলেও মানুষের জীবন বদলায় না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাষ্ট্রচিন্তা ও সমাজ সচেতনতা ক্লাসরুমে বসে তৈরি হয়নি। বরং ক্ষমতার রূপান্তর ও সমাজের বহমান সংকট বয়ে বেড়ানো সময়ে বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তিনি রাজনৈতিক সচেতনতার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে চলতে থাকা যান্ত্রিক কণ্ঠ মানুষের মধ্যে যেসব ইলিউশন তৈরি করত, তিনি সেটিকে পরখ করতে পেরেছিলেন খুব কাছ থেকে।
মানুষের ভেতরের অস্থিরতা তিনি টের পেয়েছিলেন খুব ছোটবেলায়। কিশোর বয়সে একবার শুনতে পান গ্রামে একজন আত্মহত্যা করেছে। নিজেও নিজেকে হত্যা করা যায়, এই দৃশ্যের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন না। বালক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেখানে গিয়ে দেখতে পান, একটা মানুষ কলাগাছের মতো ঝুলছে। পুঁজিবাদের কাছে পরাজিত লোকটির দেহ যেন বাতাসের কাছেও পরাজিত হচ্ছিল।
উপনিবেশের সময় পেরিয়ে পাকিস্তান গঠনকালে যেসব পরিবার পড়াশোনা ও পেশাগত কাজে কলকাতায় ছিলেন, তাদের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে পরবর্তীকালে তিনি উল্লেখ করেন ‘পলাশীর প্রান্তরের ঘটনার পর সবচেয়ে বড় অঘটন’ হিসেবে। তাঁর পরিবার ঢাকায় ফিরে এসে পানি-বিদ্যুৎহীন এক পরাবাস্তব জীবনের মুখোমুখি হয়। বাঙালি মুসলমানদের অনেকেই ভেবেছিল পাকিস্তানে জীবন সহজ হবে। যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন, তা পূরণ না হওয়ার বিষয়টি ছিল ক্রমশ প্রকাশ্য।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ক্রমেই বুঝতে পারেন, ব্যক্তিগত উন্নতি ও রাষ্ট্রের দেখানো ‘ইলিউশন’ কখনোই মানবতার মুক্তি দিতে পারে না। সবাই যদি একসঙ্গে থাকার কারণেই সমাজ গঠিত হয়, তবে এগিয়ে যেতে হলেও সবাইকে একসঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে। কারণ সমাজে প্রচলিত ভয়ংকর বৈষম্য তাঁকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।
একাত্তরের সংগ্রাম এ অঞ্চলের মানুষকে বড় ধাক্কা দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দেখে রিকশা থেকে প্রায় নেমে গিয়েছিলেন তৎকালীন ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক আহমেদ কামাল। তিনি রসবোধের সঙ্গে বলছিলেন, ‘স্যার, আপনি বেঁচে আছেন?’ কারণ ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও ছিলেন ‘টার্গেট’।
এক সাক্ষাৎকারে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন বড় অপরাধের বিরুদ্ধে লড়ছিল মানুষ, তখন ছোট অপরাধগুলো ছিল না। এক ধরনের মহত্ত্ব এসেছিল, যেহেতু সকলে ছিল সহযোদ্ধা। এই সহযোদ্ধাদের ছিল অভিন্ন লক্ষ্য। লক্ষ্যের কারণেই গড়ে উঠেছিল ঐক্য। আর ছিল আপসবিমুখতা। আপসের জায়গা থেকে সরে মানুষ চূড়ান্ত জায়গায় যেতে চেয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধের পরেও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সরব ছিলেন সব সময়। প্রবীণ বয়স পর্যন্ত তিনি কথা বলে গেছেন একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থাকে ঘিরে, এখনও বলে যাচ্ছেন।
বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় তিনি শুধু রাজনৈতিক সচেতনতায় থেমে থাকেননি। বরং সংস্কৃতি উদ্দীপনা এবং শিল্প-সাহিত্যে আমাদের জাগরণ নিয়েও সব সময়ই উজ্জীবিত করেছেন।
বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক দ্বন্দ্ব ও তর্কে সব সময়ই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অর্থনৈতিক প্রভাবকে দায়ী করেছেন। বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আধুনিক সংস্কৃতির যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটিকেও তিনি পুঁজিবাদী ভাবধারার কর্মকাণ্ডের জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
বস্তুত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক চিন্তা, দার্শনিক ভাবনা কিংবা সাহিত্য সমালোচনা– সবকিছুই আন্তঃযোগাযোগ তৈরি করতে পেরেছে। যেমনটা ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পাতা, ডাল কিংবা শিকড়কে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হয় একটি বৃক্ষ। আবহমানকাল ধরে চলে আসা সাহিত্যপাঠককে শুধু নান্দনিক বলে ব্যাখ্যা না দিয়ে, সেটির গভীরতা ও দর্শনকে সামনে আনতে যে রাজনৈতিক দর্শনের প্রয়োজন, তিনি তা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রচার করেছেন স্বার্থহীনভাবে।
যখন আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে আবেগাপ্লুত, তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন পুঁজিবাদও কিন্তু পেয়েছে স্বাধীনতা। সামরিক শাসনের ভেতর জীবন যতটুকু প্রস্ফুটিত হয়েছিল, সে সময়ও ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে বৈষম্যহীন সমাজের পাঠ দিয়েছিল এক বৃক্ষ, যার হৃদয় আছে। যে বৃক্ষ ৮৮ বছরে নুয়ে পড়েছে জ্ঞানের কাছে।
আজ, ২৩ জুন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৯তম জন্মদিনে জানাই পরম শ্রদ্ধাঞ্জলি।
জুবায়ের ইবনে কামাল: তরুণ লেখক
- বিষয় :
- শুভ জন্মদিন