পেনশন
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন বৃহত্তর স্বার্থে

প্রতীকী ছবি
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান ও মো. জাহিদ-আল-মামুন
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪ | ২৩:৫৫
১ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশনের আওতায় ‘প্রত্যয়’ স্কিমে তাদের অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণভাবে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন। তাদের দাবি এ-সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে তাদের অন্তর্ভুক্তি ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির আহ্বানে এ কর্মবিরতি চলমান। ফলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১ জুলাই থেকে একযোগে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা স্বীয় স্বার্থে তাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করছেন?
এর উত্তরে বলা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকরা বরাবরই অন্য সব সরকারি কর্মীদের মতো পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ তাদের জন্য নতুন কোনো স্কিমের প্রয়োজন ছিল না। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই জোরপূর্বক তাদের নতুন এই পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা বিশেষত বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত দর্শনের পরিপন্থি। পেনশন পরিচালনা পর্ষদে শিক্ষকদের কোনো প্রতিনিধিও রাখা হয়নি, যা বর্তমান সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নের ধারণারও পরিপন্থি। এ ছাড়া প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বহুলাংশে বৈষম্যের শিকার হতে বাধ্য করবে।
অধিকন্তু নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দিন বদলের ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি এবং পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কারণ তারা বুঝেছিলেন, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা না গেলে সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি, এ দেশের শিক্ষক সমাজ বারবার বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। ২০১৫ সালে পে কমিশন শিক্ষকদের পদোন্নতি সর্বোচ্চ তৃতীয় গ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নীতি গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক সমাজ আন্দোলন করে দ্বিতীয় এবং প্রথম গ্রেডে পদোন্নতির দাবি আদায় করে। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন হয়নি।
এ রকম ধারাবাহিক বৈষম্য এবং বর্তমানে জোরপূর্বক সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দর্শন, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী অঙ্গীকার, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়ন ও স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের গত ২ জুলাইর প্রেস রিলিজ অনুযায়ী ৩০ জুন ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যেসব শিক্ষক/কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে রয়েছেন, তারা আগের মতো সব পেনশন সুবিধা প্রাপ্য হবেন। সুতরাং একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ধরনের শিক্ষকের জন্য দুই ধরনের পেনশন ব্যবস্থা বৈষম্যের সৃষ্টি করবে এবং কম সুবিধার প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ নষ্ট করবে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে যদি বলা হয়, প্রত্যয় স্কিম মূলত বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের নীলনকশা এবং এই বিবেচনায় তা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি, তাহলে কি ভুল হবে?
মূলত বিদ্যমান পেনশন স্কিমে বেতন থেকে টাকা কাটা না হলেও প্রত্যয় স্কিমে কাটা হবে বেতনের ১০ শতাংশ। আগে একজন অধ্যাপক অবসরকালে গ্র্যাচুইটি বাবদ এককালীন ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা পেলেও বর্তমান নিয়মে তা পাবেন না। আবার আগে পেনশনের ওপর বছরপ্রতি ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা থাকলেও নতুন স্কিমে থাকছে না এ সুবিধা। এ ছাড়া নতুন স্কিমে মাসিক চিকিৎসা ভাতা, দুটি উৎসব ভাতা ও একটি বৈশাখী ভাতার উল্লেখ না থাকাসহ কমছে আরও কয়েকটি সুবিধা। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা মেধাবীদের আকর্ষণ হারাতে পারে– এই আশঙ্কায় সারাদেশের শিক্ষকরা লাগাতার কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ ধারাবাহিকভাবে মার্চ মাস থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে এলেও একটি বিশেষ মহল সমস্যাটি সমাধানে কোনো আলোচনার উদ্যোগ না নিয়ে উপরন্তু বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক ও অসত্য বক্তব্য দিয়ে শিক্ষক তথা শিক্ষা ব্যবস্থাকে হেয় করে আসছে।
১ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের আন্দোলন বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকদের স্বার্থে নয় বরং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন; বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার আন্দোলন; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের আন্দোলন।
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান: সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মো. জাহিদ-আল-মামুন: প্রভাষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- পেনশনের টাকা