উচ্চারণের বিপরীতে
আর কোন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়া বাকি?

মাহবুব আজীজ
মাহবুব আজীজ
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৪ | ২২:৫১ | আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৪ | ২২:৫২
দুর্নীতি, অনিয়ম আর অনৈতিকতার খবরে আকীর্ণ গত কয়েক সপ্তাহের পত্রিকার প্রথম পাতা। অবশ্য খবর না বলে ‘কেলেঙ্কারি ফাঁস’ বলাই সংগত। সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ, রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর, বনখেকো মোশাররফসহ নানা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির ভয়ংকর দুর্নীতির খবর ফাঁস হওয়ায় যখন সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত; এর মধ্যে চ্যানেল টোয়েনটিফোর সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসএসির গুরুত্বপূর্ণ ৩০ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে উঠে আসে, খোদ পিএসসির কর্মকর্তারাই প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত। প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন সিআইডি রেলওয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে; তাদের পাঁচজন পিএসসির বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারী। আরেকজন ১০ বছর আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসএসি থেকে চাকরিচ্যুত গাড়িচালক আবেদ আলী।
আবেদ আলী ৮ জুলাই গ্রেপ্তার হবার আগ পর্যন্ত মাদারীপুরের ডাসার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে প্রচার চালাচ্ছিলেন।
এই নির্বাচনের তপশিল এখনও হয়নি। তাঁর পুত্র ও ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামকেও প্রশ্ন ফাঁসের একই ঘটনায় অন্যদের সঙ্গে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
বিসিএসসহ পিএসসির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের যে বিরাট আয়োজন, তার পুরোটা জানা যায় না। যেটুকু টিভি পর্দায় ফাঁস হয়েছে, তাতে দেখা যায়– আবেদ আলী সাভারসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় একেক সময় দু-তিন দিনের জন্য বড় আকারের ঘর ভাড়া করছেন। সেখানে একেক রাতে ৫০-৬০ জন ছাত্রকে ফাঁস করা প্রশ্ন মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে! ভোরে মুখস্থ করা উত্তর নিয়ে সেই ছাত্ররা যায় পরীক্ষার হলে, শতকরা ৭৫ থেকে ৮০ পেয়ে পাস করে। চাকরি পায়, বিনিময়ে মাথাপিছু ২ থেকে ১০ লাখ টাকা নেন আবেদ আলী!
হায় বিধি! দেশের পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় কোন অলৌকিক উপায়ে এত গুপ্ত কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে? সাভারের মতো রাজধানীর নিঃশ্বাসঘেঁঁষা অঞ্চলে একখানা ঘরে সারারাত ৫০-৬০ জন ছাত্রের সাড়ম্বর জমায়েত হয়, পুলিশ কিছুই জানে না– এটা বিশ্বাস করবার কারণ দেখি না। দেশের পুলিশ বাহিনী অবশ্যই তৎপর, তারা ছাত্র জমায়েতের ওপর সর্বদা প্রখর নজরদারি করে থাকে; তবে আবেদ আলীর বিপুলসংখ্যক ছাত্রের রাত্রিকালীন ‘পরীক্ষা মুখস্থ’ কর্মকাণ্ড পুলিশ ও যাবতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সকল অন্তর্জাল বরাবর কোন প্রক্রিয়ায় ভেদ করে চলে– এই ঐন্দ্রজালিক শক্তির রহস্য ভেদ করলে সমস্যার একটি দিকের সমাধান মিলবে।
আরেকটি দিক হচ্ছে, আবেদ আলী চেয়ারম্যানের গাড়িচালক। প্রশ্ন ফাঁসে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা মাটি ফুঁড়ে নেমে আসেনি। গাড়িচালক, অফিস সহকারী, ডেসপাচ রাইডার– সবই সুতোর এক প্রান্ত। এদের হাতে বাতাসে উড়ে প্রশ্নপত্র আসে না। প্রশ্নপত্র তৈরি যারা করেন, সুতোর আরেক প্রান্তে থাকেন তারা, মূল কর্তাব্যক্তিরা– কমিশনের চেয়ারম্যান, সদস্যরা। তাদের ইশারা, প্রশ্রয় ছাড়া এদের পক্ষে প্রশ্ন ফাঁস করা সম্ভব নয়। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা কিছুই জানতেন না। ড্রাইভার, আরদালিরা নিজেরাই সব করেছে। তা বাপু, আপনি, মাননীয় পিএসসি চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ– আপনারা ওই পদে থেকে কোন দায়িত্ব পালন করেছেন? প্রশ্নপত্র আপসে ফাঁস হয়ে যায়, লাখ-কোটি টাকায় তা বিক্রি বাট্টা হয়; ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর রীতিমতো ঘর ভাড়া করে সারারাত জেগে ছাত্রদের মুখস্থ করানো হয়; সেই ‘প্রশ্ন ফাঁস’ ছাত্ররা চাকরিও পায়– এতসব হয়ে যায়, আপনারা কিচ্ছুটি টের পান না!
পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান গত মঙ্গলবার বলেছেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস করা ভীষণ কঠিন। ছয় সেট প্রশ্ন থেকে পরীক্ষার আগ মুহূর্তে লটারিতে প্রশ্নপত্র নির্ধারিত হয়।’ মাননীয় চেয়ারম্যান, এই শিশুতোষ যুক্তি দেখিয়ে শাক দিয়ে তিমি ঢাকা যাবে না। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে, তারা এক সেট প্রশ্ন ফাঁস করে হাত গুটিয়ে কেন বসে থাকবে? যে এক সেট প্রশ্ন ফাঁস করতে পারে, সে ছয় সেট প্রশ্নও ফাঁস করতে পারে। আসলে যেনতেনভাবে প্রবোধ দেওয়া এসব কর্তাব্যক্তিই সমাজে গাড়িচালক আবেদ আলীদের মূল চালক। একটি-দুটি আবেদ আলী মাত্র ফাঁস হচ্ছে। আরও অনেক আবেদ আলী বহাল তবিয়তে।
সরকারি চাকরিতে এমনিতেই পদ সীমিত। পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার অর্থ হলো, চাকরির জন্য যারা সত্যিকারের যোগ্য, তারা বাদ পড়ে। অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজরা চাকরি পাওয়ায় জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার প্রভাব প্রশাসনের সর্বস্তরে পড়ে। অনিয়ম ও দুর্নীতিই অযোগ্যদের অন্বিষ্ট, তাতেই তারা মনোযোগ দেয়। উচ্চপদে যারা বসে আছে, তাদের অযোগ্যতা তাই বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘উচ্চপদে অযোগ্যরা বসে আছে বলেই এমন (প্রশ্ন ফাঁস) সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তা না হলে দিনের পর দিন কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে? অযোগ্যদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ জরুরি’ (সমকাল, ১১ জুলাই ২৪)।
২.
মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা তো বটেই, পঞ্চম কি অষ্টম শ্রেণির প্রশ্ন ফাঁসের খবরও সংবাদমাধ্যমে আসে। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বিসিএস পরীক্ষা বাতিলের ঘটনাও আছে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষি দপ্তর– সর্বত্র প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। আসলে যাবতীয় নৈতিকতা দলিত করে আস্তাকুঁড়ে নির্বিকার ছুড়ে ফেলাই হচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের চূড়ান্ত বাস্তবতা! মেধাবী প্রজন্ম দেশের প্রকৃত সম্পদ। যথার্থ মেধাবীকে রক্ষায় প্রতিটি পর্যায়ের পরীক্ষায় আইনের সঠিক ও চূড়ান্ত প্রয়োগ তাই জরুরি।
৩.
আমাদের দেশের নির্বাচনগুলোও প্রশ্ন ফাঁসের মতো দোষে দুষ্ট হয়ে গেছে। কখনও নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়া, কখনও বিরোধী দল ছাড়া কোনোরকমে নিজেদের মধ্যে নির্বাচন করবার মধ্য দিয়ে দেশে যে একদলীয় নির্বাচনের সংস্কৃতি জারি হয়েছে, তা প্রশ্ন ফাঁসের দুর্নীতির দোষে দুষ্ট। দেশের মানুষ পাঁচ বছর পরপর ভোটের আগে থেকেই জানে, কোন দল আর কোন নেতা তাদের দেশ পরিচালনা করতে আসছে– এর চেয়ে বড় প্রশ্ন ফাঁস আর কী হতে পারে?
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪– পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রধান বিরোধী দলের উপস্থিতি ছাড়া অনুষ্ঠিত হওয়ায় জাতীয় সংসদ সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে। এই ভারসাম্যহীনতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে জবাবদিহিহীনতার ক্ষেত্র তৈরি করে। সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের প্রাণবন্ত বিতর্ক, যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতির নতুন দিকনির্দেশনা মেলে। দায়িত্বে থাকে সরকারি দল; তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবার জন্য বিরোধী দলের উপযুক্ত উপস্থিতি প্রয়োজন হয়। গত এক যুগে যে একদলীয় সংসদীয় কার্যক্রম আমরা দেখছি, তা প্রশ্ন ফাঁসের মতোই– আগে থেকে সব জেনে যাওয়া; এখানে ক্ষমতাসীন দল বা নেতৃত্বের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করে না। এই আপাত বিতর্কহীন নিরুত্তাপ, একদলীয় ও প্রশ্নহীন যে সমাজ সংসদ ও সংসদের বাইরে প্রসারিত হয়েছে, তারই পরিণতি দুর্নীতি, অনিয়ম ও অনৈতিক কেলেঙ্কারি ফাঁসের খবর। পিএসসির প্রশ্ন ফাঁসও এরই অংশ।
মাহবুব আজীজ: সমকালের উপসম্পাদক ও সাহিত্যিক
[email protected]
- বিষয় :
- প্রশ্নফাঁস