রাষ্ট্র সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে কতিপয় প্রস্তাব

প্রতীকী ছবি
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৮:১০
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বারবার তাদের বক্তব্যে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এ ক্ষেত্রে আংশিক বিজয় অর্জিত হয়েছে মাত্র; এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এ দেশ থেকে স্থায়ীভাবে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মূলোৎপাটন। ফলে নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরতে পরতে যেসব ফ্যাসিবাদী উপকরণ লুকিয়ে রয়েছে, সর্বাগ্রে সেগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা। এ চিহ্নিতকরণের কাজটি যথাযথভাবে করতে না পারলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যদের মধ্যে সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যম যত গভীর ও
আন্তরিকতাপূর্ণভাবেই বিরাজমান থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের কাজটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কিছুটা হলেও থেকেই যাবে। তাই উল্লিখিত সংস্কারের কাজটি যাতে পূর্ণাঙ্গ ও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সম্পন্ন হতে পারে, সে জন্য সংস্কারসংশ্লিষ্ট ক্ষতগুলোকে পর্যাপ্ত মনোযোগ ও সতর্কতার সঙ্গে চিহ্নিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রস্তাব হচ্ছে: প্রথমে প্রতিটি মন্ত্রণালয় তার আওতাধীন ক্ষেত্রগুলোয় বিরাজমান ক্ষত চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের লক্ষ্যে তিন-চার বছর মেয়াদি একটি সময়ভিত্তিক (টাইম বাউন্ড) কর্মপরিকল্পনা (অ্যাকশন প্ল্যান) প্রণয়ন করবে। আর কাজটি সব মন্ত্রণালয়কে একটি অভিন্ন নীতি-নির্দেশনার আওতায় একই ছক ও কাঠামো অনুসরণ করে করতে হবে, যাতে পরে এসবের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পরিধারণ ও আন্তঃখাত সমন্বয়ের বিষয়টি সহজ হয়। সে লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব শুধু এ বিষয় নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে মিলিত হয়ে মন্ত্রণালয়গুলোকে নীতি-নির্দেশনা দেওয়া এবং এর আলোকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পরবর্তী দু-তিন দিনের মধ্যে একটি ছক তৈরি করে মন্ত্রণালয়গুলোকে সরবরাহ করা। উল্লিখিত বিষয়গুলো মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
উক্ত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য নীতি-নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকে সব মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি অভিন্ন সময়সীমাও বেঁধে দিতে হবে। উল্লিখিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে মন্ত্রণালয়গুলোকে সাহায্য করার জন্য বাইরে থেকে অবৈতনিক ভিত্তিতে শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও বিষয় বিশেষজ্ঞদের যুক্ত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, জাতির এ পুনর্গঠনের আয়োজনে কাজগুলোর সঙ্গে বিনা পারিশ্রমিকে যুক্ত হওয়ার জন্য দেশের বহু গুণীজনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবেন। যাহোক, মন্ত্রণালয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর্মপরিকল্পনার খসড়া প্রণীত হয়ে যাওয়ার পর উপদেষ্টা পরিষদের পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটি চূড়ান্ত করা যেতে পারে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এটি অবশ্যই চূড়ান্ত করতে হবে, যাতে ১ অক্টোবর থেকে এর বাস্তবায়ন শুরু করা যায়, আর বাস্তবায়ন অগ্রগতির পর্যালোচনা শুরু করা যায় ১ নভেম্বর থেকে। কাজটি যাতে সময় মেনে সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে এগিয়ে যেতে পারে, সে জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের আওতায় একটি শক্তিশালী পরিধারণ ও সমন্বয় সেল গঠন করা যেতে পারে। এ সমন্বয় সেলের সাচিবিক সহযোগিতায় প্রতিমাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের পূর্ণাঙ্গ সভায় সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
সদ্যবিদায়ী সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে ধস নামানো, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গোষ্ঠীবিশেষকে সুবিধাদান, মেগা প্রকল্পের আড়ালে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ, অন্যায্যভাবে বিশেষ বিশেষ ব্যবসায়িক শ্রেণিকে হাজার হাজার কোটি টাকার নগদ প্রণোদনা প্রদান, বাছবিচারহীনভাবে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ইত্যাদি। তবে এ সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় যে সর্বনাশটি শেখ হাসিনা গত ১৫-১৬ বছরে করে গেছেন তা হচ্ছে– রাষ্ট্রের সাংবিধানিক, সামাজিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া (তৎকালীন সরকার না বলে শেখ হাসিনার নাম বলা হলো এ কারণে যে, সবকিছুই তিনি করেছেন একক সিদ্ধান্তে এবং সেটি বলতেও তিনি বেশ পছন্দ করতেন। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কখনোই ‘আমরা’ বলতেন না, বলতেন ‘আমি’)। তিনি বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ইত্যাদিকে তাঁর করতলগত করেছিলেন। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে দলীয় ভিত্তিতে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের শত শত বছরের ঐক্য ও সংহতির শক্তি পুরোপুরি বিনষ্ট করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনার বিদায়ের পর সম্প্রতি দেশের গ্রামগুলোতে যে ব্যাপক হানাহানি হয়েছে, সেটি ওই দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আয়োজনেরই ফল।
একইভাবে পুলিশ ও জনপ্রশাসনের সদস্যদের নানা অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা ও অবাধ দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের তিনি নিজের ক্ষমতা রক্ষার কাজে ব্যবহার করেছেন। তদুপরি জনপ্রশাসনের ভেতরেও দলীয় পরিচয়ভিত্তিক এমন এক ধরনের কোটারি সৃষ্টি করেছেন, যা আমলাতন্ত্রের মৌলিক চেতনার পরিপন্থি। একটি জবাবদিহিপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনপ্রশাসনের সদস্যরা তাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক চিন্তা, বিশ্বাস ও আদর্শের ঊর্ধ্বে ওঠে আইন বিভাগের সিদ্ধান্ত ও নীতিনির্দেশনা পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করবেন, সেটাই কাম্য। কিন্তু বিগত সরকার আমলাতন্ত্রের সেই মৌলিক চেতনাটিকে এমনভাবে বিনষ্ট করে দিয়েছে, এটিকে এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুবই কষ্টসাধ্য। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যরা যেহেতু কোনো বিশেষ দলের প্রতিনিধি নন, সেহেতু তারা যদি বিষয়টিতে দৃঢ়তার সঙ্গে উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাহলে এ ক্ষেত্রে একটি আদর্শ মান ও পরিবেশ প্রতিষ্ঠা পুরোপুরিভাবে না হলেও অন্তত ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত সম্ভব হবে বলে মনে করি। এবং পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই, এ কাজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে করাটাই সবচেয়ে সহজ হবে। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার এটি করতে চাইবে কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
গত ১৫ বছরের মধ্যে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক পদে অধিকাংশ নিয়োগই হয়েছে দলীয় বিবেচনায়, যে শিক্ষকদের মেধা ও যোগ্যতার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করা হয়। এবং সে কারণে বিশিষ্টজনেরা এখন মনে করছেন, নিম্ন মেধার শিক্ষক নিয়োগের কারণে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান আগামী দুই দশক ধরে অনেকটাই নিম্নবর্তী হয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থায় উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান ধরে রাখার স্বার্থে সেখানে গত ১৫ বছরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে দেখার জন্য জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করে তাদের মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষকদের বাদ দেওয়া যেতে পারে। জনপ্রশাসনে দলনিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টির মতো উপরোক্ত কমিশন গঠনের কাজটিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে করাটাই অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হবে বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা বলে, দলীয় সরকার এসে কাজটি হয়তো আদৌ করতেই চাইবে না।
শেখ হাসিনা বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পরামর্শে ও নিজ পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘমেয়াদি ইতিহাসের পাতায় জবরদস্তিমূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করার আকাঙ্ক্ষায় বারবার বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তকের লেখা ও তথ্যাদি পরিবর্তন করেছেন। এমনকি কোথাও কোথাও ইতিহাস বিকৃতির মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন। এ সময়ে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ন্যায়নীতি ও নীতিমালার তোয়াক্কা না করে একেবারে উলঙ্গভাবে দলীয় বিবেচনায় এসব পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টির পরিবর্তে এ সময়ে দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে হলগুলোর সিট বণ্টনসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রমের দায়িত্ব। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করি। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব রয়েছে। সদ্য দায়িত্ব গ্রহণকারী সরকারকে সেসব প্রস্তাবও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
বিগত সরকার তথা শেখ হাসিনা গত দেড় দশকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নিজের ক্ষমতা রক্ষার অনুগামী করতে গিয়ে একে এমন এক চরিত্র দিয়েছেন, সেটিকে গণতান্ত্রিক আদলে ফিরিয়ে আনাটা খুবই কষ্টকর এবং অনেকটাই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপরও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু কাজ তো শুরু করতেই হবে এবং এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আছে বিধায় সে দায়িত্ব তাদেরই পালন করতে হবে। তবে এর মধ্যেও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজটি যেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। সে ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ আদায়, রেমিট্যান্স আহরণ বৃদ্ধিকরণ, অর্থ পাচার রোধ ও পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা, রাজস্ব আদায় বাড়ানো, রপ্তানি সম্প্রসারণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর যা কিছুই করা হোক না কেন, সবকিছুর কেন্দ্রে রাখতে হবে দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের স্বার্থকে; যাদের বা যাদের সন্তানদের বুকের রক্তে এ গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে।
আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়
- বিষয় :
- রাষ্ট্রব্যবস্থা
- সংস্কার