নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে রুয়ান্ডা ডকট্রিন: প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

গত জুলাইয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা শাহবাগে কর্মসূচি পালন করেন
সম্রাট মোঃ আবু সুফিয়ান
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯:১৫
৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের পর আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, তা যেন বাস্তবতার সঙ্গে অনেকাংশেই মিলছে না। আমরা যে মুক্ত বাতাসের স্বাদ পেয়েছিলাম, তা আমাদের অতিলোভ, হিংসা-বিদ্বেষ, অশ্রদ্ধা, অধৈর্য এবং জিঘাংসার জন্য হারিয়ে যেতে বসেছে। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, আমরা একজন আরেকজনের ধন-সম্পদ লুট করছি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছি, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বিভিন্ন রকম মামলা দিচ্ছি, ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি তো আছেই। মানুষ গড়ার কারিগর যে শিক্ষকরা, তারা আজ বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে। যে ডাক্তার এবং পুলিশরা ২৪ ঘণ্টা জনগণের সেবায় নিয়োজিত, তারা আজ ছোট ছোট বিভিন্ন ইস্যুতে আক্রান্ত হচ্ছে। পুলিশের মুষ্টিমেয় কিছু রাজনৈতিক পদলেহনকারী দুবৃত্তায়িত চাটুকার, দুর্নীতিপরায়ণ সিনিয়র কর্মকর্তারা অপরাধ করলেও আক্রান্ত হচ্ছে অন্যরা। প্রতিহিংসার এ আগুন এখনই না নেভানো হলে কোনোভাবেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ফল পাব না। কেউই নিরাপদ থাকব না।
এ প্রসঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলাকে স্মরণ করা যায়, যিনি ২৭ বছর রুবেন দ্বীপের অন্ধকার কারাগারে অসহনীয় নির্মম যন্ত্রণা ভোগের পরও দক্ষিণ আফ্রিকায় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকা। রুয়ান্ডাও এ ক্ষেত্রে আমাদের পথ দেখাতে পারে, যেখানে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসযজ্ঞের পরেও আজ তারা এক ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছে।
বর্ণবৈষম্যের দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে নতুন এক আফ্রিকা গড়ার কাজটি সহজ ছিল না। তবে ম্যান্ডেলা হালও ছেড়ে দেননি। অত্যাচারী সরকারের সঙ্গেই শান্তিচুক্তি করেছিলেন শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবাদমুক্ত করার জন্য, দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য, জাতিগত বিভেদ দূর করার জন্য। ম্যান্ডেলা এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারবে, যেখানে থাকবে না কোনো একক জাত বা বর্ণের মানুষের কর্তৃত্ব। তাই ১৯৯৪ সালে বিপুল ভোটে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে এক নতুন আফ্রিকার স্বপ্নের বীজ বপন করেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা মানে “কেবল শৃঙ্খলহীন হওয়া নয়; বরং স্বাধীন হওয়া মানে শ্রদ্ধা এবং অন্যের স্বাধীনতা বৃদ্ধির সঙ্গে বসবাস”। আমরা স্বাধীনতার স্বাদ তখনই উপলব্ধি করতে পারব, যখন অন্য মতাবলম্বীদের (ক্ষুদ্র ধর্মীয় ও নৃগোষ্ঠী বা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী দল) সঙ্গে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের সঙ্গে বসবাসের পরিবেশ তৈরি করতে পারব, যেখানে সবাই নিজেকে স্বাধীন মনে করবে এবং নিরাপদ অনুভব করবে। তিনি বলতেন, “ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়, কৌশলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না”। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।
তিনি বলতেন “আমি সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এবং আমি কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি আদর্শিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজের প্রশংসা করি, যেখানে সব ব্যক্তি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে এবং সমান সুযোগসুবিধা লাভ করবে। এটি হচ্ছে একটি আদর্শিক অবস্থান, যার মধ্য দিয়ে বাঁচা দরকার এবং আমি তা অর্জনের আশা করি, কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ, যদি প্রয়োজন পড়ে, তার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।”
দক্ষিণ আফ্রিকার মতো রুয়ান্ডাও ছিল পরস্পরের প্রতি চরম বিদ্বেষপোষণকারী দুই জনগোষ্ঠীর দেশ। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মাঝামাঝি অবধি মাত্র ১০০ দিনের ব্যবধানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় প্রায় ৮ লাখ মানুষকে, যাদের বেশির ভাগই ছিল সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের। এই ভয়াবহ নির্যাতন পরিচালনাকারীরা ছিল সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায়ভুক্ত। গড়ে প্রতিদিন নিজের দেশের প্রায় ৮০০০ মানুষকে হত্যা করার নজির পৃথিবীর মানুষ কেউ কোনোদিন চিন্তাও করতে পারেনি। উভয় জনগোষ্ঠী দেখতে প্রায় একই রকম, ভাষা ও গায়ের রংও একই রকম, এমনকি শারীরিক গঠনও প্রায় একই রকম (শুধু তুতসিরা একটু লম্বাটে এবং চিকন গড়নের ছিল)। তথাপি খুব ছোট্ট কিছু বিষয়–যেমন তুতসিদের পূর্বপুরুষেরা ইথিওপিয়া থেকে রুয়ান্ডায় পাড়ি জমিয়েছিল–(যেগুলো মূলত বেলজিয়ামের সৃষ্টি। রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের উপনিবেশ ছিল) নিয়ে তারা এক নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে, যেখানে প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে হত্যা করে, হুতু স্বামী তাদের তুতসি স্ত্রীদের হত্যা করে। এমনকি হুতু ধর্মযাজকেরা তুতসিদের হত্যা করার ব্যাপারে প্ররোচনা দিয়েছে, তাদের মনের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। অসংখ্য নারী এবং শিশুদের হত্যা করার পাশাপাশি হাজারো তুতসি নারীকে যৌনদাসী করা হয়। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে, তানজানিয়ার আরুশা শহরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল বসে, যেখানে গণহত্যার অভিযোগে দোষীদের বিচার করা হয়। পাশাপাশি রুয়ান্ডাতে সামাজিক আদালতও বসে, যার উদ্দেশ্য ছিল হাজার হাজার অভিযুক্তকে অপরাধে স্বীকারোক্তির বিনিময়ে সমাজে পুনর্বাসন করা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আমার সুযোগ হয়েছিল পূর্ব আফ্রিকার এ দেশটি ভ্রমণের। এ এক অনন্য রুয়ান্ডা। দেশের প্রতিটা প্রান্তর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, প্রত্যেক মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কোথাও কোনো ট্রাফিক পুলিশ দেখা যায় না, কিন্তু মানুষ ট্রাফিক আইন মান্য করছে। মানুষ একান্ত বাধ্য না হলে গাড়ির হর্নও বাজায় না। মধ্যরাতেও কোনো নারী এখানে অনিরাপদ বোধ করে না। মনে হচ্ছিল, এত ধ্বংসযজ্ঞের পরেও রুয়ান্ডা সেই ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে। রুয়ান্ডা বর্তমানে একটি স্থিতিশীল এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিত। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশটি প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বর্তমানে তাদের মাথাপিছু আয় প্রায় ১০০০ ডলার যেখানে ১৯৯৫ সালে যেখানে তাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৫ ডলার। আজ রুয়ান্ডার জেগে ওঠার মূল কারণ হচ্ছে তাদের জনগণ এখন স্পষ্ট মনে করে যে, তারা না হুতু, না তুতসি, তারা হচ্ছে রুয়ান্ডিয়ান। রুয়ান্ডা আজ গভীরতম ক্ষত থেকে সেরে ওঠার এবং অন্ধকারতম খাদ থেকে জেগে উঠে শক্তিশালী সমাজ গঠনে মানব সক্ষমতার শক্তিশালী সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদের দেশ আজ এক নতুন সময় অতিক্রম করছে। আমরা যদি এই সময়ের স্রোতে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে না নিতে পারি, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা কখনোই মুখ তুলে দাঁড়াতে পারব না। আসুন, আমার ভাই, আমার প্রতিবেশী যেন আমার দ্বারা আক্রান্ত না হয়, এই শপথে বলীয়ান হই। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটা অন্যায়কে কোনো দিনই আরেকটা অন্যায় দিয়ে দমন করা যায় না। অন্যায়কে দমন করতে হয়, ন্যায় দিয়ে। কাজটি কঠিন, হয়তো খুবই কঠিন, তারপরেও সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে ন্যায় দিয়েই অন্যায়কে দমন করতে হবে। অন্যায় দিয়ে দমন করতে গেলে হিংসা তৈরি হবে, বিদ্বেষ তৈরি হবে, সমাজে ভেদাভেদ তৈরি হবে, মানুষে মানুষে জিঘাংসা তৈরি হবে। সমাজ তথা দেশের উন্নয়ন যদি আমরা চাই, তাহলে সেটা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেই করতে হবে।
লেখক: সম্রাট মোঃ আবু সুফিয়ান, পুলিশ সুপার (পুলিশ অ্যাডভাইজার হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কঙ্গো থেকে ফেরত পদায়নের অপেক্ষায়)