ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সাদা কালো

আওয়ামী লীগের ভবিতব্য কী?

আওয়ামী লীগের ভবিতব্য কী?

সাইফুর রহমান তপন

সাইফুর রহমান তপন

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:২৮ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:২৯

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নজিরবিহীন বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার আগে-পরে এ ভূখণ্ডে গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতন অনেকবারই ঘটেছে; কিন্তু কোনোবারই ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের প্রধানকে দেশ ছাড়তে হয়নি। অভূতপূর্ব এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি তো বটেই, মাঠপর্যায়ের নেতারাও প্রায় হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন। 

ক্ষমতাচ্যুত দলটির নেতারা প্রকাশ্য থাকবেই বা কীভাবে? শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায়–পদধারী প্রায় সবারই বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা হচ্ছে। লুকিয়ে থাকা নেতারা একটু বাইরে এলেই হয় গ্রেপ্তার হচ্ছেন, নয় গণপিটুনিতে পড়ছেন। কয়েকজন বেঘোরে মারাও গেছেন। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আওয়ামী লীগই গঠন করেছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে, সেই 
ট্রাইব্যুনালেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের জুলাই-আগস্ট সময়কার ‘গণহত্যা’ সংঘটনের দায়ে বিচারের আয়োজন চলছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট আইনে অপরাধ সংঘটনকারী দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধের বিধান যুক্ত করে আইনটিতে সংশাধনীও আনা হচ্ছে; যার প্রথম শিকার হতে পারে আওয়ামী লীগই।
আসলে ১৫ জুলাই রাতেই বোঝা গিয়েছিল পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। সেদিন বিকেলে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোটা সংস্কার নিয়ে 
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারধর করে। এর পাল্টা হিসেবে রাতেই শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে হলগুলোতে অভিযান শুরু করলে ছাত্রলীগ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগমুক্ত হয়ে পড়ে। 

তখনই স্পষ্ট হয়, গত ১৫ বছরে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মিছিলে যে হাজার হাজার শিক্ষার্থী দেখা যেত, তাদের বৃহৎ অংশই ছিল অনুপ্রবেশকারী অথবা স্বার্থান্বেষী। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হলগুলো দখলে নেয় ছাত্রলীগ, ফলে ঢাকা শহরে ঠিকানাহীন বিরোধী মতের বা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংগঠনটির আনুগত্য স্বীকার না করে উপায় ছিল না। আবার এ শিক্ষার্থীদের দীক্ষা দেওয়ার নামে গণরুম, গেস্টরুম কালচার ইত্যাদির মাধ্যমে ছাত্রলীগের নেতারা যা করেছেন, সেটি আরও বড় কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়। ফলে কোটা আন্দোলনের দৌলতে হলগুলোর ওইসব বাসিন্দা স্বমূর্তিতে দেখা দেন।
নগর পুড়লে যেমন দেবালয় বাঁচে না, তেমনি ঐতিহাসিক কারণেই ছাত্র সংগঠন দুর্দশাগ্রস্ত হলে এ দেশে মূল দলও ভালো থাকতে পারে না। তাই আমরা দেখেছি, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা গলার সব রগ ফুলিয়ে বিশেষত দলের সভানেত্রীকে অভয় দেওয়ার স্বরে বলতেন, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তারা দল ও নেত্রীকে রক্ষা করবেন, তারাই দলের ঘোর বিপদের দিনে সবার আগে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করেছেন।

গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারে যে মাত্রায় সুযোগসন্ধানীর ভিড় বেড়েছিল এবং এদের চাপে দলের আদর্শিক কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, তাতে অবশ্য এমনটা হওয়ারই কথা ছিল। যে কোনো দলের আদর্শিক কর্মী-সমর্থকই তার সঙ্গে জনগণের সংযোগসড়ক রূপে কাজ করে; সেসব কর্মী-সমর্থক যখন দর্শক বনে যায় তখন দলটির প্রাণহীন দেহটাই শুধু থাকে। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় আমরা আওয়ামী লীগের সেই দেহটাই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়তে দেখেছি। 

স্মরণ করা যেতে পারে, পরপর তিনটি নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার বঞ্চনা নিয়ে যখনই সমালোচনা হতো, তার জবাব হিসেবে তৎকালীন সরকারপ্রধান বলতেন– এ দেশের জনগণ ‘ভোটচোরদের’ ক্ষমতায় রাখে না, তেমনটা হলে তাঁর সরকারও একই শাস্তি পেত। শেষ পর্যন্ত কি তাঁর সে কথাই সত্য হলো না? এদিক থেকে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির আজকের মহাবিপর্যয়কে অপ্রত্যাশিত বলা যায় না। 
এখন প্রশ্ন হতে পারে, দলটি অন্তত অদূরভবিষ্যতে আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা। এর উত্তর একবাক্যে দেওয়া আসলেই কঠিন। আশাবাদীরা হয়তো ইতিহাস টেনে ইতিবাচক কথাই বলবেন। আমরা জানি, পাকিস্তানের স্রষ্টা মুসলিম লীগের মধ্য থেকে নিরাকরণ প্রক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনে প্রথম প্রায় অবলুপ্তির শিকার হয়, যখন অন্য দলগুলোর মতো আওয়ামী লীগেরও প্রায় সব শীর্ষ নেতা সরকারের নির্দেশনা মেনে দল পুনরুজ্জীবিত না করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে মুখ্যত দলটির তৎকালীন অপেক্ষাকৃত তরুণ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের একক প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ নতুন রূপে ফিরে এসেছিল। আবার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুসহ দলটির প্রধান চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ আরও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। প্রায় ২১ বছর লাগলেও দলটি সেটিও কাটাতে সক্ষম হয় শেখ মুজিবেরই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।

অন্যদিকে সংশয়বাদীরা বলবেন, ৫ আগস্ট জনগণের কাছে ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা পেয়ে যেভাবে দলটি দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকেই বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে, তা তার ফিরে আসার পথকে কণ্টকিত করে দিয়েছে। অন্তত এ ধারার মানুষেরা মনে করেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক যে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহাবয়ান আওয়ামী লীগের মূল রাজনৈতিক পুঁজি, তা এবারের গণঅভ্যুত্থান ভেঙে দিয়েছে; তাই রাজনৈতিক হাতিয়ারবিহীন দলটির সহসা ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। 

আবার, এটাও স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশের প্রাণভোমরা হলো মুক্তিযুদ্ধ? এর ফসল হিসেবেই বাঙালি ইতিহাসে প্রথম নিজের একটা রাষ্ট্র পেয়েছে, যার গোটা প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগই ছিল নেতৃত্বে। সন্দেহ নেই, অন্তত ২৬ মার্চ থেকে পাকিস্তানবিরোধী যে সশস্ত্র যুদ্ধ হয়, তা ছিল একটা ধ্রুপদি অর্থেই জনযুদ্ধ। কিন্তু এটাও সত্য, গত ৫৩ বছরে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলই বাঙালির এ মহান অর্জনকে নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা করেনি; বরং আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে ডান-বাম সবাই একভাবে মুক্তিযুদ্ধকেও ক্ষেত্রবিশেষে হেয় করতে চেয়েছে। এখনও কি গণঅভ্যুত্থানেরই মূল অংশীজনের মধ্যে পরোক্ষ হলেও এমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না? ইতোমধ্যে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগেরই বয়ান ধীরে ধীরে জনমানসে প্রাধান্য বিস্তার করছে। 
আরেকটি বিষয় হলো, দলটির প্রাণ যে সাধারণ কর্মী-সমর্থক বিগত সময়ে দূরে চলে গিয়েছিল, তারাই কিন্তু এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হলেও দলের পক্ষে ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠছে। অন্তত গণঅভ্যুত্থানের তাত্ত্বিক বলে আজ পর্যন্ত যাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারাও স্বীকার করছেন, আওয়ামী লীগের এই বিশাল সমর্থকগোষ্ঠীর কারণেই দলটিকে ‘নিষিদ্ধ’ করা যাবে না।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে নতুনভাবে দাঁড়াতে চান, জনগণ কি মুখ ফিরিয়ে থাকবে? আমার তো মনে হয়, সেই আশঙ্কা দিনে দিনে বরং কমে আসবে, বিশেষত জনজীবনে বিরাজমান জ্বলন্ত সমস্যাগুলো যদি এ সরকার প্রতিশ্রুতি মতো সমাধানে আন্তরিক না হয়।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল; সাবেক ছাত্রনেতা 

আরও পড়ুন

×