ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সাদা কালো

সংখ্যাগুরুর সঙ্গে সংখ্যালঘুর আস্থা অর্জনও জরুরি

সংখ্যাগুরুর সঙ্গে সংখ্যালঘুর আস্থা অর্জনও জরুরি

সাইফুর রহমান তপন

সাইফুর রহমান তপন

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪ | ০৮:৫০

পাঁচ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ দেশে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র’ নির্মাণের সুযোগ এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা যতই দাবি করুন, বাস্তবতা ভিন্ন বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষত সরকার পতনের অব্যবহিত পর থেকে অন্য অনেক সমস্যার পাশাপাশি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনাবলিতে এমন সংশয় সংগত। 
সম্ভবত দেড় দশকের জগদ্দল সরানোর হরিষের মধ্যে বিষাদের খবর দিতে চায়নি বলে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমেও সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ক খবরগুলো শুরুর দিকে গুরুত্ব পায়নি। তবে অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না। তাই ৫ আগস্ট সন্ধ্যা থেকেই সামাজিক মাধ্যমে খোদ নির্যাতিত বা তাদের স্বজন ও বন্ধুদের বরাতে প্রকাশিত হতে থাকে, অভ্যুত্থানের বিজয়োল্লাসের পাশাপাশি প্রধানত হিন্দুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটছে। দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানেও গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশ হয়, ৫ থেকে ২০ আগস্ট দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৯টিতে অন্তত ১০৬৮টি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে; নিহত হয় ২ জন। 

জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বাস করেন, সেখানকার অবস্থাও অজানা নয়। গত এক মাসে দু’দফা পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে সেখানে অন্তত ৫ জন প্রাণ হারিয়েছে; সর্বস্ব হারিয়েছে দু’পক্ষেরই বহু মানুষ। আরও গুরুতর বিষয়– এসব সংঘাত-সংঘর্ষে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে পাহাড়িদের মধ্য থেকে। পরিস্থিতি এমনই যে, সংখ্যায় পাহাড়িদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ তাদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবরদান পালন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা এতই প্রবল যে, স্থানীয় প্রশাসনের বারবার আশ্বাসেও তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাচ্ছে না। 

একই অবস্থা হতে পারত বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা নিয়েও। স্বরাষ্ট্রসহ কয়েকজন উপদেষ্টা পূজা উদযাপন পরিষদসহ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করে নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ পূজার সব ধরনের প্রস্তুতিতে সহায়তার আশ্বাস দেন। তারপরও ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ কুমারীপূজা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অবশ্য অতিসম্প্রতি সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের পর তারা সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।

সব মিলিয়ে এবার যে সেনা পাহারায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্গাপূজা হবে, তা তো সত্যিই অভূতপূর্ব। এ প্রশ্নও তো অমূলক নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে উদ্যোগী অন্তর্বর্তী সরকারের সময় দেশের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপাসনালয় কেন সার্বক্ষণিক সেনা পাহারায় থাকতে হবে?

এ কথা সত্য, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতা একদিনে তৈরি হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই কম-বেশি এ অবস্থা চলে এসেছে। সব সরকারের আমলে তাদের ওপর হামলা-নির্যাতন তো ছিলই; শত্রু সম্পত্তি আইন বা অর্পিত সম্পত্তি আইনের আওতায় প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি সংখ্যাগুরু মুসলিমদের একাংশ দখল করেছে। এমনকি যে আওয়ামী লীগ সরকার বারবার তাদের সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগ নিজের দিকে টেনেছে, তারাও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ২০০০ সালে অনেক দেন-দরবারের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ‘অর্পিত’ সম্পত্তি বৈধ মালিকদের ফেরত দেওয়ার কথা বলে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করেছিল বটে, কিন্তু তার কার্যকর প্রয়োগ আজও ঘটেনি। এমনকি ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে দলটি যে ১৫ বছরের বেশি সময় সরকার চালাল, সে সময়ও আশ্বাস আর আইন সংশোধনের বাইরে কোনো অগ্রগতি হয়নি। 

গত ১ অক্টোবর সমকালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছয় বছরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয় ৩০৭টি। কিন্তু এ পর্যন্ত অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০৭টিতে; বিচার শেষ একটারও হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যাগুরুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি তারা প্রতিষ্ঠা করলেও, এখন সংখ্যালঘু মানুষদের মনে এ জিজ্ঞাসা জোরালো হয়ে উঠছে– রাষ্ট্রটি আদৌ তাদের কিনা।

বলা বাহুল্য হবে না, অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে, রাষ্ট্রের ওপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনাস্থা দূর করাও বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেটি পাচ্ছে বলে মনে হয় না। যদি পেত তাহলে খোদ সরকারি মহল থেকে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সম্পর্কে এমনটা বলা হতো না– হামলাগুলো যতটা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে ক্ষমতাচ্যুতদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ঘনিষ্ঠতার কারণে। সন্দেহ নেই, ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর প্রবণতা প্রতিবেশী ভারতের সরকার ও মিডিয়ার আছে। কিন্তু কোনো অঘটনের কারণ হিসেবে এ ধরনের ষড়যন্ত্রই যদি সরকারের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে, তাহলে ভুক্তভোগীর যন্ত্রণা অনুভব তার পক্ষে সম্ভবপর হয় না। তখন সরকারের আশ্বাসও ভুক্তভোগী নাগরিকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পায় না।

স্মরণ করা যেতে পারে, ১৩ আগস্ট– দায়িত্ব গ্রহণের পাঁচ দিনের মাথায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘বড় রকমের একটা বিভেদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এমন বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাচ্ছি, যেটা একটা পরিবার; এটাই হচ্ছে মূল জিনিস। এই পরিবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা, বিভেদ করার প্রশ্নই আসে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশি।’ এ সময় ৫৩ বছরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও বৈষম্যের বিচারে একটি কমিশন গঠনের দাবি জানান সম্প্রদায়ের নেতারা। শুধু তাই নয়; একই দিনে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় তাঁর সঙ্গে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু বিভিন্ন সংগঠনের ৪০ জন প্রতিনিধি বৈঠক করেন। সেখানেও বিভিন্ন দাবির সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা ওই কমিশন গঠনের দাবি জানান। আজ পর্যন্ত সেই দাবির প্রতিফলন সরকারের কাজে দেখা যায়নি। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠিত হয়েছে। এগুলোর সঙ্গে সংখ্যালঘু নেতাদের দাবি মেনে আরেকটা কমিশন গঠন করা হলে এমন কী সমস্যা হতো?

এখনও দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজা উপলক্ষে তৈরি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়ের অভিযোগও অব্যাহত। এ পরিস্থিতি যে নাগরিকদের একটা অংশের সঙ্গে সরকারের সেতুবন্ধ প্রায় অসম্ভব করে তোলে, তা কি ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন আছে?

সরকার যদি সত্যিই সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে একই পরিবারভুক্ত মনে করে, তাহলে প্রথমেই শেষোক্তদের মাঠের আন্দোলন থেকে টেবিলে নিয়ে আসতে হবে। তাদের আস্থা অর্জনে তারও আগে সংখ্যালঘু নেতাদের উত্থাপিত আট দফার গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো বাস্তবায়নে কাজ শুরু করতে হবে। অবশ্য পূর্বসূরিদের মতো এ সরকারও যদি দেশের অন্তত ৮ শতাংশ মানুষের যে কোনো কর্মকাণ্ডকেই সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে, তাহলে তো সকলই গরল ভেল!

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
 

আরও পড়ুন

×