সচল নদীর মতো সংগ্রামী জীবন

মতিয়া চৌধুরী (১৯৪২-২০২৪)
এম এম আকাশ
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪ | ০২:৩১
কৈশোরে ‘অগ্নিকন্যা’ মতিয়া চৌধুরী সম্পর্কে জেনে বেশ উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। সেটি ছিল বাঙালির জীবনে সবচেয়ে উত্তাল সময়। ষাটের দশকের আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মতিয়া চৌধুরীর সাহসী ভূমিকা এবং জেলখানার বিবরণী পড়ে উৎসাহিত হই। পরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্রাফট হোস্টেলে তাঁকে সরাসরি দেখেছি। এ সময় তিনি আমাদের রুটি বানানো তত্ত্বাবধান করতেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনেকটা পাল্টে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীর ওপর গুলি করা হলো এবং ন্যাপের অফিস উশ্রী নামের বাড়িট পোড়ানো হলো। মতিয়া চৌধুরী তখন রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করে পল্টনে ন্যাপের পক্ষ থেকে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমরাও পরদিন ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর শাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম হরতাল করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে ইতিহাসে বাঁক কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।
আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল জাতীয়করণ পদক্ষেপ ও ’৭২-এর সংবিধানের পক্ষে এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নন-মার্ক্সিস্ট সোশ্যালিজমের তত্ত্বের ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি অনুসরণ করি। মতিয়া চৌধুরী তখন পর্যন্ত ন্যাপেই ছিলেন। ১৯৭৫ সালে যখন বাকশাল গঠিত হয়, তখনও আমরা সবাই মিলে সমাজতন্ত্রের পক্ষে সেই দলে অংশগ্রহণ করেছিলাম; যদিও কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত ছিল মৈত্রী জোট করলে ভালো হতো এবং এক দল করা ঠিক হয়নি। মতিয়া চৌধুরীও বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বাকশাল আর অগ্রসর হয়নি। আওয়ামী লীগও পশ্চাদপসরণ করে। আর আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থি অংশ খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে।
তার পর বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। এক সময় মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগদান করেন; শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগীতে পরিণত হন। কিন্তু এই সহযোগিতা ছিল রাজনৈতিক; লুটপাটের কোনো সহযোগিতা ছিল না। চিরকাল নিরাভরণ মতিয়া চৌধুরীর বাড়িতে তখন গিয়ে দেখেছিলাম সাদাসিদে জীবন যাপন করেছেন। দেখেছি, মুরগি পালছেন, মোড়ায় আমাকে বসতে দিচ্ছেন।
রাজনীতি মতিয়া চৌধুরীর কাছে কোনো বিনিয়োগ ছিল না। রাজনীতি তাঁর কাছে কোনো মুনাফা বা রিটার্ন ছিল না। রাজনীতি ছিল তাঁর কাছে জনসেবা। যদিও আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ক্রমাগত দক্ষিণপন্থি আপস, লুটপাট এবং অন্যান্য সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। মতিয়া চৌধুরীকেও তখন কোনো কোনো সময় দেখে লজ্জা পেয়েছি। এগুলোর বিরুদ্ধে উনি শক্তভাবে দাঁড়াচ্ছেন না কেন! যদিও আবার এরশাদবিরোধী আন্দোলন অথবা জামায়াতের বিরুদ্ধে কোনো কোনো সংগ্রামে তাঁর বীরোচিত ভূমিকা প্রশংসনীয়।
২০২৪ সালে এসে আমরা ছাত্র-জনতার যে গণঅভ্যুত্থান দেখলাম, সেখানে সেই সময়ের মতিয়া চৌধুরীকে দেখেছি একদম নিষ্প্রভ, নীরব এবং পেছনে লুকানো। আমার মনে হয়, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জনগণের এই ন্যায়সংগত বিক্ষোভের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটা ঠিক নয়। যাই হোক, শেখ হাসিনা যে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার পতন হয়েছে এবং তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
মতিয়া চৌধুরী বীরের মতো নিজের বাসাতেই ছিলেন এবং বীরের মতোই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁকে আমার শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাই। ব্যক্তি মানুষকে মূল্যায়নের সময় সর্বদা আমার টলস্টয়ের সেই বাণীর মতো মনে হয়– ‘মানুষের জীবন হচ্ছে নদীর মতো’। কোথাও সে স্বচ্ছ, কোথাও অস্বচ্ছ, কোথাও খরস্রোতা, কোথাও বদ্ধ ও স্থবির, কোথাও গভীর, কোথাও অগভীর। মতিয়া চৌধুরীর জীবনও ছিল এ রকমই নদীর মতো; নিরন্তর সচল ও সংগ্রামী জীবন।
এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ; সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- মতিয়া চৌধুরী