কতটুকু জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছিল সংবিধানের সংশোধনীগুলো?

প্রতীকী ছবি
শিহাব উদ্দিন খান
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ | ১৩:৫৮ | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ | ১৫:১৪
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের মৌলিক ও সর্বোচ্চ আইন। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, জনগণের মৌলিক অধিকার, সরকার পদ্ধতি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মৌলিক নিয়মকানুন উল্লেখ থাকে সংবিধানে। বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীনতার পরপরই খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছিল। সংবিধান প্রণয়ন হয়েছিল গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিতদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। সংবিধান প্রণয়নের ওই প্রক্রিয়া নিয়ে সে সময় মওলানা ভাসানীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রশ্ন তুলেছিল। তারা গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা এবং জনগণের ম্যান্ডেট নেই বলে প্রশ্ন তুলেছিল। তারা গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান অনুমোদনের দাবি জানিয়েছিল।
সংবিধান প্রণয়নের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী এনেছে। সংশোধনীগুলো নিয়ে বিতর্কও দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে সংবিধান নিয়ে আলোচনা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীগুলো কতটুকু জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছিল, সেই বিশ্লেষণ চলমান সংবিধান পুনর্লিখন কিংবা সংস্কার প্রশ্নে খুবই প্রাসঙ্গিক।
সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৩ সালে। উদ্দেশ্য ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রণীত আইন ও বিধানাবলির সুরক্ষা দেওয়া। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছিল একটি জনদাবি। তবে শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা ও বিচার প্রশ্নে কিছু অস্পষ্টতা রয়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। এর ফলে এই বিচার নিয়ে ব্যাপক রাজনৈতিক বিভেদের সৃষ্টি হয়। ১৯৭৩ সালে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী এনে জরুরি অবস্থা যুক্ত করে মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিতের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া সংযুক্ত হয় বহুল সমালোচিত নিবর্তনমূলক আটকের বিধান। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত সীমানা নির্ধারণী চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৪ সালে তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়। ওই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ১৯৭৫ সালে বহুল আলোচিত চতুর্থ সংশোধনী পাস করে একদলীয় ‘বাকশাল’ কায়েম করা হয়। বাকশাল ব্যবস্থা জনগণের মধ্যে ভয়াবহ ভীতির সঞ্চার করে এবং নাগরিকদের রাজনৈতিক ও মতপ্রকাশের অধিকার সংকুচিত হয়।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে (১৯৭৯) বিগত সময়ের সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড বৈধতা দেওয়া হয়। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’র বদলে সংযোজন হয় ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করা হয়। পঞ্চম সংশোধনী রাজনীতিতে নতুন রাজনৈতিক দর্শন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠা করে। তবে শেখ মুজিব হত্যার বিচার ও আরও কিছু প্রশ্নে পঞ্চম সংশোধনীর সমালোচনা রয়েছে। সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক শাসনকালে প্রণীত সব ফরমান ও অধ্যাদেশ বৈধতা দেওয়া হয়। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি প্রদান ও ঢাকার বাইরে ছয়টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের বিধান চালু হয়। এই সংশোধনী এরশাদ পতন পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাকে বৈধতা দিয়েছিল। এরপর সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী স্বৈরশাসন থেকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক উত্তরণে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়, যা দেশে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ব্যবস্থায় আস্থা ফেরাতে ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১১ সালের ৩০ জুন পাস হয় বহুল বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী। এতে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া একই বিলে নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে হাসিনা সরকার ১/১১ সময়কালকে সাংবিধানিকভাবে বৈধতা না দেওয়ায় প্রকারান্তরে ২০০৯ এবং তার ধারাবাহিকতায় ২০১২, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে গঠিত সংসদ আইনত অবৈধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনী এনে ’৭২-এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য হাইকোর্ট ওই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে। আপিল বিভাগও তা বহাল রাখে। ষোড়শ সংশোধনী নিঃসন্দেহে বিচার বিভাগকে চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল।
সংবিধানের সংশোধনীগুলো বিশ্লেষণ করলে মোটাদাগে তিনটি ধরন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম, তৃতীয়, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ সংশোধনীগুলো ছিল আপেক্ষিকভাবে প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম, চতুর্দশ ও সপ্তদশ সংশোধনী ছিল শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং বহুলাংশে রাজনৈতিক প্রয়োজনে। আর দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ সংশোধনী ছিল সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা। দুঃখজনক, হাতেগোনা কয়েকটি সংশোধনী ছাড়া সংবিধানের প্রায় সব সংশোধনী কেবল ব্যক্তি, দল ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায়, শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিপালনে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কৌশল হিসেবে আনা হয়েছিল; যা ছিল জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক এবং লজ্জার।
সংশোধনীগুলোর সামগ্রিক মূল্যায়ন করলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উচ্চারিত ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ নিশ্চিতের ধারণাটিকে ‘কাজীর গোয়ালের গরুর’ মতোই মনে হয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও রাষ্ট্রে সমঅধিকার নিশ্চিত হয়নি, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার সবার ক্ষেত্রে এক রকম নয়। অধিকার ও বিচারের প্রশ্নে সর্বত্র বৈষম্য ও অসন্তোষ বিদ্যমান। সাধারণ মানুষের চাওয়া একটি সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, যেখানে দুর্নীতি থাকবে না, থাকবে আইনের শাসন ও জবাবদিহি। কিন্তু শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে জনগণের এই আশা-আকাঙ্ক্ষা অধরাই রয়ে গেছে। মূলত এসব হয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে। বাংলাদেশের সংবিধানে সরকার ও সরকারপ্রধানের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই।
এ ছাড়া এই সাংবিধানিক কাঠামোতে নির্বাহী বিভাগকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত করা হয়েছে। বিচার বিভাগ নামমাত্র স্বাধীন। সংসদে দলীয় আনুগত্য সর্বাবস্থায় বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের মূলনীতি বিষয়ে কখনোই জনগণের সরাসরি ম্যান্ডেট না নেওয়ায় তৈরি হয়েছে আদর্শিক বিভেদ। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের কোনো সরকারই সংবিধানে ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহি নিশ্চিতের মতো জরুরি বিষয়ে পরিবর্তন আনার চিন্তা কখনও করেনি। ফলে সংবিধানের এ যাবৎকালের সংশোধনীগুলো হয়েছে শুধু শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজনে ও রাজনৈতিক কারণে। সেখানে মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রেখে উদার ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা একেবারেই গুরুত্ব পায়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী এই যুগসন্ধিক্ষণে সংবিধানে জন-আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিতের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। তবে এই কাজের সফলতার জন্য দরকার অন্তর্বর্তী সরকারের সত্যিকারের প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য এবং বাস্তবায়নযোগ্য রোডম্যাপ।
শিহাব উদ্দিন খান: ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
[email protected]
- বিষয় :
- সংবিধান
- মতামত
- সংবিধান সংশোধনী