ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

প্রতিবেশ

উপকূলে আগ্রাসী অস্ট্রেলিয়ান পাইনের বাগান বন্ধ হবে কবে?

উপকূলে আগ্রাসী অস্ট্রেলিয়ান পাইনের বাগান বন্ধ হবে কবে?

মোহাম্মদ আরজু

মোহাম্মদ আরজু

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫১

উপকূলীয় সৈকত, বিশেষত ‘ডেইল’ বা বালুর ঢিবির প্রতিবেশগত পুনরুদ্ধার বিষয়ে সমকালে লিখেছিলাম গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর। এক বছরে সেখানকার প্রতিবেশগত অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। সৈকত ও ডেইলের এই অবনতি রোধ ও প্রতিবেশগত পুনরুদ্ধারে কী করতে হবে, বিশেষজ্ঞরা জানেন। সেসব কর্মসূচি বাস্তবায়নেও অনেক বছর লাগবে। কিন্তু কয়েকটি কাজ খুব অনায়াসে ও অল্প সময়ে করা সম্ভব। দরকার শুধু সরকারের সদিচ্ছা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। 

সিদ্ধান্তগুলো নিতে কোনো নতুন তহবিলের দরকার নেই। বরং তহবিলের অপচয় বন্ধ হবে। যেমন সরকার চাইলে যথাসম্ভব দ্রুত এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে– উপকূল, সৈকতে ও ডেইলে আর কখনও ক্ষতিকর অস্ট্রেলিয়ান পাইন গাছের বাগান হবে না। অস্ট্রেলিয়ান পাইনের বিদ্যমান বাগানগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্রমশ তুলে দিতে হবে।
সরকার এ সিদ্ধান্তও নিতে পারে, ক্ষতিকর অস্ট্রেলিয়ান পাইনের বদলে ডেইলে স্থানীয় জাতের লতা-গুল্প-গাছপালা ফিরিয়ে আনার কর্মসূচি নেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, অস্ট্রেলিয়ান পাইন দেশে বিলিতি ঝাউগাছ বা শুধু ঝাউগাছ নামে পরিচিত। ঝাউ বাংলাদেশে একটি আগ্রাসী-আগন্তুক গাছ। এর উপদ্রবে ডেইলে স্থানীয় জাতের গাছপালা বিলুপ্তপ্রায়। বিশেষত কক্সবাজারে ঝাউ-উপদ্রুত সৈকত ও ডেইলগুলোতে কেয়া, নিশিন্দা, আকন্দ, ফণিমনসা, শ্যাওড়ার মতো স্থানীয় জাতের উদ্ভিদ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পাইনের ক্ষতিকর প্রভাবে মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ায় ভূমিক্ষয় ও উপকূলীয় ভাঙন বাড়ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে। স্থানীয় জনজীবন, সম্পত্তি, বিশেষত কৃষি হুমকিতে পড়েছে ভাঙন, প্লাবন ও মৌসুমি লবণাক্ততার কারণে।

কোথাও অস্ট্রেলিয়ান পাইনের উপদ্রব ঘটলে তা কীভাবে মোকাবিলা ও ব্যবস্থা করতে হবে, সে বিষয়ে দরকারি গবেষণা রয়েছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) এশিয়া ও প্যাসিফিক আঞ্চলিক অফিস ২০১৩ সালের এক প্রকাশনায় বলেছে, অংকুর, চারা ও অল্পবয়সী গাছগুলো একটা একটা করে উপড়ে ফেলতে হবে। পরিণত গাছগুলোকে আগাছানাশক দিয়ে বা কেটে সাফ করতে হবে।
এশিয়া-প্যাসিফিক ফরেস্ট্রি কমিশন এবং এশিয়া প্যাসিফিক ফরেস্ট ইনভেসিভ স্পিসিস নেটওয়ার্কের প্রস্তুতকৃত প্রকাশনাতেও বাংলাদেশের মতো দেশে অস্ট্রেলিয়ান পাইনের উপদ্রব সামলাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। যদি উপযোগী পরিবেশ থাকে, তবে ঝাউবাগান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে।

এফএও আরও জানায়, অস্ট্রেলিয়ান পাইন একবার গেড়ে বসলে সৈকত এলাকার মৃত্তিকা রসায়নের সবকিছু মৌলিকভাবে বদলে ফেলে। এই বদলে ফেলার মাধ্যমে পাইন গাছগুলো বেড়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় স্থানীয় জাতের উদ্ভিদগুলোকে হারিয়ে দেয়; শেষ পর্যন্ত নির্মূল করে ফেলে। যার মধ্য দিয়ে স্থানীয় জাতের কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য প্রাণীর আবাসস্থলও নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে ঝাউবাগানের মাটির প্রতিবেশগত মৃত্যু ঘটে; সৈকত বন্ধ্যভূমি ও নিষ্ফল হয়ে যায়। ভূমিক্ষয় বাড়ে, ঝড়-তুফান-জলোচ্ছ্বাসে সহজেই ভাঙনের শিকার হয় সমুদ্রসৈকত। আর ঝড়ো বাতাস এলে সবার আগে উপড়ে পড়ে ঝাউগাছ।
পরিহাসের বিষয়, বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান পাইনের উপদ্রব ঘটানো হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। বনায়নের নামে দশকের পর দশক ধরে উপকূলে এই ক্ষতিকর আগ্রাসী গাছের বাগান করেছে বন বিভাগ। অথচ অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয় গাছ অস্ট্রেলিয়ান পাইন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশেই ক্ষতিকর আগ্রাসী-আগন্তুক প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত।
এখন সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ এই, উপকূলীয় প্রতিবেশ রক্ষা ও ভাঙন ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এই ‘বাগান-বিলাস’ বন্ধ করুন। উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমি, প্রতিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্যের সর্বনাশ করে ফেলছে অস্ট্রেলিয়ান পাইন। কাজেই আর দেরি না করে ব্যবস্থা নিন। বিভিন্ন গবেষণা ও প্রকাশনায় আগ্রাসী-আগন্তুক উদ্ভিদের বিস্তার ও উপদ্রব রোধে যেসব ব্যবস্থাপনা পদক্ষেপ ও সুপারিশ করা হয়েছে, সে অনুসারে রূপরেখা ও নানা ধাপের পরিকল্পনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিন।

বস্তুত সরকারি উদ্যোগে না হলেও, নানাভাবে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রেও ঝাউগাছের উপদ্রব ঠেকাতে নানা ব্যবস্থাপনামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যে অনেক দশক আগে দমকা হাওয়া ঠেকানোর চিন্তায় এই আগন্তুক ঝাউগাছ লাগানো হয়েছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে। কিন্তু সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে পরে ফ্লোরিডার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঝাউয়ের উপদ্রব বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেও অনেক বছর হলো। সৈকত ও ডেইল এলাকা থেকে যথাসম্ভব ঝাউগাছ উপড়ে ফেলে ভূমি-প্রতিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্য নিরাপদে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশটি। কথা হলো, ভুল করলে সেই ভুল শোধরাতেও হয় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে। 

বর্তমান দুরবস্থা থেকে উত্তরণে সৈকতে পাকা ঢালাই করে দেয়াল বানানোর চেষ্টা করে ধ্বংস ত্বরান্বিত করার বদলে যৌক্তিক ও প্রাকৃতিক সুরক্ষার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। ক্ষতিগ্রস্ত ডেইল পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসনের প্রথম ধাপ হলো হিসাবে বন বিভাগের ভুল স্বীকার। এর পর সুচিন্তিত পরিকল্পনার আলোকে অস্ট্রেলিয়ান পাইন বাগান উচ্ছেদ করে ওইসব জায়গায় ক্রমশ স্থানীয় জাতের উদ্ভিদ ফিরিয়ে আনা। এ উদ্দেশ্যে স্থানীয় লোকসমাজ, জেলে সমিতি, কৃষক সমিতি ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে সমন্বিত পদক্ষেপ নিলে উত্তম হবে।

মোহাম্মদ আরজু: অধিকারকর্মী

আরও পড়ুন

×