উন্নয়ন
দারিদ্র্য বিমোচনে চাই টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ

ছবি: ফাইল
মো. জসীম উদ্দিন
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪ | ০৩:১২
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) প্রায় দুই কোটি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। জোগান দিয়ে যাচ্ছে নতুন প্রত্যয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে পিকেএসএফ প্রতিষ্ঠা করলেও এর পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। তখন থেকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চলে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। অবশেষে ১৯৮৯ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ‘ফাউন্ডেশন’ গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করেন। পরিশেষে ১৯৯০ সালের এপ্রিলে পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২ মে কোম্পানি আইনে নিবন্ধন লাভ করে পিকেএসএফ। দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সংগ্রাম শুরু সেখান থেকেই।
শুরু থেকে সক্রিয় সদস্য হিসেবে নীতি নির্ধারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পিকেএসএফের বুনিয়াদকে শক্তিশালী করার পেছনে ভূমিকা রাখেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান, শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বিশ্বব্যাংক প্রস্তাবিত ‘ফাউন্ডেশন’ গঠনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন এবং সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দেশীয় ভাবধারায় ভিন্নধর্মী একটি ফাউন্ডেশন গঠনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পেয়ে তিনি ফাউন্ডেশনের রূপরেখা প্রণয়ন করেন, যা বর্তমানের পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ‘পিকেএসএফ’কে রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন দেশবরেণ্য সব প্রথিতযশা ব্যক্তি। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইদুজ্জামানকে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের তদানীন্তন মহাপরিচালক আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে ফাউন্ডেশনের সদস্য হিসেবে সরকার মনোনয়ন দেয়। এ ছাড়া প্রস্তাবিত ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদের অন্য তিনজন বেসরকারি সদস্যের মনোনয়ন মহামান্য রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করেন। তারা হলেন বেগম তাহেরুন্নেসা আব্দুল্লাহ, এ.এ. কোরেশী এবং অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। পিকেএসএফের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সরকার বদিউর রহমানকে মনোনীত করে।
মাত্র ৩ কোটি টাকার তহবিল নিয়ে যাত্রা শুরু করা পিকেএসএফের বর্তমানে মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। কৃষি, অকৃষি, সেবা, ক্ষুদ্র উদ্যোগসহ সারাদেশে কর্মসৃজনের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে পিকেএসএফ জন্মলগ্ন থেকে শুধু ঋণ বিতরণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি। একই সঙ্গে এ ঋণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাচ্ছে কিনা এবং সে ঋণ ব্যবহার করে কর্মসৃজন হচ্ছে কিনা, সে বিষয়টি নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা হয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ঋণ পৌঁছা সাপেক্ষে পিকেএসএফ থেকে সহযোগী সংস্থাগুলোকে পরবর্তী অর্থ ছাড় করা হয়। অর্থাৎ পিকেএসএফ থেকে ঋণ বিতরণের পর ঋণের যাত্রাপথ পরীক্ষা করে তা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছেছে কিনা, এটি নিবিড়ভাবে যাচাই করা হয়।
ফাউন্ডেশন সৃষ্টির পর থেকে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ দেশের বিভিন্ন দুর্যোগে পিকেএসএফ ও এর সহযোগী সংস্থাগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। দুর্যোগকালীন ত্রাণ বিতরণ থেকে শুরু করে দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন ও নতুন কর্মসৃজনে সহযোগিতা প্রদান পিকেএসএফের নৈমিত্তিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই পরিচালিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে পিকেএসএফের বড় সাফল্য হচ্ছে মঙ্গা দূরীকরণে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখা এবং মঙ্গাকেন্দ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। লবণাক্ততাপ্রবণ দক্ষিণাঞ্চলের দরিদ্র খানা পর্যায়ে সুপেয় পানি সংকট নিরসনে পিকেএসএফ গ্রহণ করেছে বিশেষ কার্যক্রম, যা এখনও চলমান। ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল সংরক্ষণ ও সংখ্যা বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ, উন্নত পদ্ধতিতে গাভি পালন ও পারিবারিক দুগ্ধ খামার স্থাপন, রেড চিটাগং ক্যাটলের জাত উন্নয়ন, সংরক্ষণ, সম্প্রসারণসহ সমন্বিত কৃষি খাতে ব্যাপক কর্মসূচি রয়েছে এ ফাউন্ডেশনের।
পিকেএসএফ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান তৈরির কারিগর হওয়ার পাশাপাশি উদ্যোক্তা তৈরির কারিগররূপে অবতীর্ণ হয়। এর অর্থায়নে প্রায় ৩৫ লাখ সংগঠিত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছে। উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে প্রায় ১১শ ভিক্ষুক। নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি পিকেএসএফ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় বর্তমানে ক্ষুদ্র উদ্যোগবান্ধব বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে উন্নয়ন সংস্থাগুলো পিকেএসএফের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান কাজের আগ্রহ ব্যক্ত করে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ গোমাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পেছনে পিকেএসএফের কার্যক্রমের ব্যাপক অবদান রয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে পোলট্রি শিল্পের বিকাশ ও সবজি চাষে প্রযুক্তি স্থানান্তরে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে পিকেএসএফ। বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীর প্রাকৃতিক প্রতিবেশ রক্ষায় পিকেএসএফ বিশেষায়িত কার্যক্রম গ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করেছে। পঞ্চগড়ে টিউলিপ ফুল চাষেও রয়েছে এর ভূমিকা। টিস্যু কালচারসহ ফুল চাষে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে বিশেষ কার্যক্রম। প্রায় ৪০ হাজার তরুণকে বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ফলে কেউ এখন বিদেশে, কেউ দেশে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কারও সৃষ্টি হয়েছে মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান। পিকেএসএফ সৃষ্টির ফলে আজ যেসব বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) দারিদ্র্য বিমোচনে নিরলসভাবে বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, তা সম্ভব হয়েছে। প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার এ খাত গড়ে ওঠার পেছনে পিকেএসএফের ভূমিকা অনবদ্য। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও এর রয়েছে বিশাল অবদান।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিক্ষার পাশাপাশি গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে পিকেএসএফের আছে বিশেষায়িত কার্যক্রম। ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে সদস্যদের মৃত্যুজনিত কারণে বা প্রকল্প বিনষ্ট হওয়ার জন্য ঋণ মওকুফ করার ব্যবস্থা হিসেবে সহযোগী সংস্থা থেকে ঝুঁকি তহবিল ব্যবহার করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলার এই যাত্রায় উদ্ভাবন অত্যাবশ্যক। ভাবতে অবাক লাগে, কোটি টাকার মালিকের একটি গুদাম পুড়ে গেলে বীমা কোম্পানিগুলো তার ক্ষতিপূরণে এগিয়ে আসে। অথচ প্রলয়ঙ্করী কোনো দুর্যোগে গ্রামের মানুষটি যখন বাস্তুহারা হয়; ক্ষুধার তাড়নায় পরিবারসহ যখন রাস্তায় নেমে আসে তখন তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি এ দেশে।
দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে দরিদ্র মানুষের সুরক্ষা দিতে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখন প্রয়োজন, যাতে বিশেষ বিশেষ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সদস্যদের পাশে পুঁজির নিশ্চয়তা নিয়ে দাঁড়ানো যায়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রচলিত বিভিন্ন সফল মডেল আলোচনায় নিয়ে নিজস্ব লব্ধ জ্ঞান ব্যবহারের মাধ্যমে এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
ড. মো. জসীম উদ্দিন: অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)
- বিষয় :
- উন্নয়ন
- উন্নয়ন কাজ