সংস্কৃতি
রবীন্দ্র, নজরুল ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ

ফাইল ছবি
জয়দ্বীপ রায়
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০১
ময়মনসিংহে পড়াশোনা করার সময় প্রথমবার শহরে ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরের কথা শুনি। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি রাস্তার পাশে অবস্থিত মন্দিরটি একদিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখতে যাই। কিছুটা অবাকও হই, বাংলাদেশে ইসলাম, হিন্দু, খ্রিষ্ট, বৌদ্ধ, শিখ ইত্যাদি ধর্মের বাইরেও একটি ব্রাহ্মধর্মীয় সমাজ আছে! যে ভূখণ্ডে এতগুলো ধর্ম টিকে আছে, তার সমাজটি বৈচিত্র্যের ধারক হওয়াই স্বাভাবিক।
রাজা রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর মিলে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রবর্তন করেন। সেই ধারাবাহিকতা মেনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ ধর্ম প্রচার করেন। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ও মহাশূন্যকে ঈশ্বরের সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখেছিলেন এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সাহিত্যে প্রচার করেছেন। তাঁর মহাজাগতিক ভাববাদে সংকীর্ণতার কোনো স্থান ছিল না। তিনি প্রকৃতির এক বিশেষ আশীর্বাদে অভিষিক্ত ছিলেন, যা সাধারণ ইন্দ্রিয় বা চিন্তা দিয়ে বোঝা অত্যন্ত কঠিন।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে বাঙালি মুসলিম সমাজে জন্ম হয় কবি নজরুল ইসলামের, সাহিত্যাঙ্গনে যার সৃষ্টি বিস্ময়ের জন্ম দেয়। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন, তাঁর সাহিত্যকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করতেন। জানামতে, সাহিত্যে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ তাঁর দুটি বই নজরুলের নামে উৎসর্গ করেছেন। অথচ আজকের যুগে কোনো অধঃপতিত বাঙালি সাহিত্যিক যদি জানেন
যে একজন সাহিত্য বা শিল্পকলা নিয়ে কাজ করবেন, তখন তাঁকে কীভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়, এই চিন্তা করেন। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
শুধু কি তাই? স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা বাদ দিয়ে দুই ব্যক্তির তুলনা করা যুক্তিযুক্ত নয়, তা আমরা জানি। অর্থাৎ প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে দুই ব্যক্তির মিথস্ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট চিন্তাপ্রবাহ এবং তার থেকে উৎসারিত সাহিত্য ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। এটাও আমরা জানি, একজন সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক ও শিল্পী সাধারণত ধর্মীয় পরিচয় বা আঞ্চলিকতার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিল্প সৃষ্টি করেন না। শিল্পীর মন সর্বদা শিল্প সৃষ্টির দিকে থাকে, খ্যাতি বা বঞ্চনার দিকে নয়। তাই তো নজরুল বলেছিলেন: ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে/ মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/ আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।’
অথচ আজকের যুগে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে নিমজ্জিত কিছু মানুষ এবং তথাকথিত শ্রেণি রাজনীতিসচেতন কিছু বুদ্ধিজীবী বলে বেড়াচ্ছেন– রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। আমরা জানি, ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালের জুন মাসে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। ইউরোপের বাইরে প্রথম নোবেল পুরস্কার পাওয়া এই বিশ্বসাহিত্যিকের এই প্রতিবাদ ছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী একটি পদক্ষেপ।
সেই হত্যাযজ্ঞের শিকার মানুষদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু, শিখ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের। যাদের মধ্যে আমার জানামতে, রবীন্দ্রনাথের
ব্রাহ্ম ধর্মের কেউ ছিলেন না। একজন বিশ্বজনীন কবি কখনও সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। কাউকে ছোট বা বড় করা উদ্দেশ্য নয়, বরং ব্যক্তিকে নিবিড়ভাবে জানা ও ইতিহাস থেকে প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে মূল্যায়ন করাই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৭-এর দেশভাগের আগেই ১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন। তাই তাঁর সৃষ্টির সম্পর্ক ছিল অবিভক্ত বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে– আজকের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। অথচ আজকের কিছু স্থূল বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছ থেকে শুনতে হয়– তিনি একজন হিন্দু কবি ছিলেন, ভারতীয় বাঙালি কবি ছিলেন, বড়লোক জমিদার ছিলেন এবং সেই সময়ে পূর্ব বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের শিক্ষার বিস্তারে বিশ্বাস করতেন না, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সমর্থন করেননি। এসব মনগড়া অভিযোগ তুলে আমরা কী অর্জন করতে পারি? শুধুই সাম্প্রদায়িকতা? মানুষে মানুষে বিভেদ? আমার মতে, কারও সম্পর্কে বয়ান সৃষ্টির আগে তাঁর সম্পর্কে জানতে হবে। কারও সম্পর্কে কথা বলার অধিকার আমাদের হয়তো আছে, কিন্তু তা মনগড়া হতে পারে না। এ ধরনের বক্তব্য কেবল নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে। যে
ক্ষণজন্মা
সাহিত্যিকদের আমরা আমাদের বাংলা সাহিত্যে পেয়েছি, তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে সমৃদ্ধ হওয়া থেকে বঞ্চিত হবো। তাই বিভাজনের এ খেলায় মেতে ওঠার চেয়ে আমাদের উচিত এই দুই মহৎ সাহিত্যিকের সৃষ্টিকে সম্মান জানিয়ে তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।
আসুন নিজেকে সমৃদ্ধ করার এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সব ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভাজন পরিহার করে শুধুই সম্প্রীতির বন্ধনে যুক্ত হই। এতে গোটা দক্ষিণ এশিয়া উপকৃত হবে।
জয়দ্বীপ রায়: ইমারসিভ টেকনোলজি গবেষক, ব্রডকাস্টার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- বিষয় :
- সংস্কৃতিচর্চা