ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

শিক্ষার সাদামাটা-সহজ দুর্নীতি

শিক্ষার সাদামাটা-সহজ দুর্নীতি

মোহাম্মাদ আসাদ উজ জামান

মোহাম্মাদ আসাদ উজ জামান

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০২

শিক্ষায় নানা ধরনের দুর্নীতি আছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল, শিক্ষক নিয়োগে অর্থ বাণিজ্য, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্য– এমন অনেক দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এর বাইরেও অনেক দুর্নীতি আছে, যা সাধারণের কাছে দুর্নীতি বলে মনে হচ্ছে না। এগুলো হচ্ছে শিক্ষার সাদামাটা-সহজ দুর্নীতি। 

প্রথম সাদামাটা-সহজ দুর্নীতি হচ্ছে, স্কুলের কোচিং বাণিজ্য।  অভিভাবকের কাছে স্কুল তুলে ধরছে যে এতে ছাত্ররা পরীক্ষায় ভালো করবে। হয়তো পরীক্ষায় ছাত্ররা ভালো করেও, তবে এতে করে একই দিন পড়ানোর জন্য একজন ছাত্রের কাছ থেকে একটি প্রতিষ্ঠান দুই ধরনের ফি নিচ্ছে– স্কুলের বেতন এবং কোচিং ফি। এতে ছাত্রকে বাধ্য করা হয় স্কুলের বেতনের বাইরেও অতিরিক্ত কোচিং ফি দিতে। 
স্কুলে কোচিং করানো শুধু অর্থের অপচয় নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাত্রের সময়।  ছাত্রকে শুধু পড়লেই হবে না, পড়া বোঝা এবং জীবনে এর প্রতিফলন ঘটাতে তাকে ভাবতে হবে। ভাবার জন্য সময় থাকতে হবে। অহেতুক কোচিংয়ের নামে একজন ছাত্রের জীবন থেকে একটি দিনের অনেকটা সময় চলে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, একটি স্কুলে দু’বার পড়তে গিয়ে ছাত্রদের ওপর মানসিক চাপ পড়ে। লেখাপড়ার প্রতি অনেকের বিরূপ মনোভাবও তৈরি হতে পারে। লেখাপড়ার সঙ্গে একজন ছাত্রকে খেলাধুলা করতে হবে, পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ শিখতে হবে। এর জন্য তাদের সময় কোথায়? কোচিংয়ের অতিরিক্ত টাকা  জোগান দিতে অভিভাবকেরাও হয়তো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। 

ঠিক একইভাবে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোও আরেকটি সাদামাটা-সহজ দুর্নীতি।  এই প্রাইভেট বাণিজ্যের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্মানও দিন দিন তলানিতে এসে ঠেকেছে। ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে যে পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্ক ছিল, তা চলে যেতে বসেছে। কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষও এই সুযোগে স্কুলশিক্ষকের বেতন একজন পিয়নের বেতনের চেয়েও কমিয়ে দিয়েছে। তারপরও সেসব স্কুলে যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক যোগদান করেন। কারণ এ স্কুলের শিক্ষক পরিচয়ে তিনি যথেচ্ছ প্রাইভেট পড়িয়ে লাগামহীন অর্থ উপার্জনে নেমে পড়তে পারবেন। অতিরিক্ত প্রাইভেট এবং কোচিংয়ের আরও একটি কুফল হলো ভালো নম্বর পাওয়ার অসাধু প্রতিযোগিতা। নিজের অসার প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্যের সুফল দেখাতে নিজের ছাত্রদের কী করে বেশি নম্বর পাওয়ানো যায়– এ নিয়ে চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। অনেক সময় শিক্ষার নীতিনৈতিকতাকে ডিঙিয়ে খোদ শিক্ষকরাই জড়িয়ে পড়েন নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গর্হিত কাজে। 
অতিরিক্ত প্রাইভেট ও কোচিংয়ের কুফল ইতোমধ্যে দেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। গত কয়েক দশকে জিপিএ ৫-এর নামে যে শিক্ষা-রম্যের জন্ম দেওয়া হয়েছে, এর দায়ভার ছাত্রদের নয়; এর পুরো দায়ভার শিক্ষক ও অভিভাবকদের; যদিও বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরাও এর দায় কিছুতেই এড়াতে পারেন না। 

এখানে উল্লেখ করা দরকার, আমাদের সন্তানদের মেধার অভাব নেই। সবারই জিপিএ ৫ পাওয়ার মেধা আছে। জিপিএ ৫-এর অর্থ হলো, একটি বিষয়ের বই সম্পর্কে স্পষ্ট এবং ভালো ধারণা থাকা। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ না থাকলে শুধু মেধা দিয়ে পুরো বই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা কঠিন। যাদের লেখাপড়ায় আগ্রহ থাকবে তাদের বেশির ভাগ জিপিএ ৫ পেতে পারে, তাই বলে গণহারে জিপিএ ৫ কোনোক্রমেই বোধগম্য নয়। অর্থাৎ গণহারে জিপিএ ৫-এর  মানে হলো, বড় ধরনের সাদামাটা-সহজ শিক্ষা দুর্নীতি; যা আমাদের বুঝতে দেরি হচ্ছে। 
স্কুল-কলেজের কোচিং এবং প্রাইভেটের পর আছে ভর্তি কোচিং। নিজেদের কোচিংয়ে ছাত্র টানতে শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়েন অসাধু প্রতিযোগিতায়। শুরু হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং অন্য কাউকে দিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দেওয়ার মতো অবৈধ ভর্তি বাণিজ্য। 

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চলে আরেক সাদামাটা-সহজ দুর্নীতি। এর সঙ্গে প্রথমেই জড়িয়ে আছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষক এবং ক্লাসরুমের তুলনায় অনেক বেশি ছাত্র ভর্তি করে। পার্টটাইম শিক্ষকের নামে এরা অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক এনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছে। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেমে এসেছে স্থবিরতা। এ দুর্নীতির প্রধান ভুক্তভোগী হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। এর 
প্রভাব পড়ছে সামাজিক ভারসাম্যে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যথেষ্ট সুযোগ থাকার পরেও বছরে সেসব প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ ছাত্রকে ডিগ্রি দিতে পারে, সেই তুলনায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কম সুযোগ-সুবিধা নিয়েও তুলনামূলক বিচারে বেশি সংখ্যক ছাত্রকে ডিগ্রি দিচ্ছে। 

এ কথা সত্য, শিক্ষকদের বেতন এবং সুযোগ-সুবিধায় বড় একটি ঘাটতি আছে। বর্তমান বাজারে শুধু বেতন দিয়ে শিক্ষকদের পক্ষে সংসার চালানো খুবই কঠিন। দেশের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন তাদের সামাজিক মর্যাদা এবং দায়িত্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে, যা শিক্ষকদের পক্ষে এখনও অর্জন করা সম্ভব হয়নি; রয়ে গেছে বড় ধরনের বৈষম্য, যা শিক্ষকদের সাদামাটা-সহজ দুর্নীতিতে ঠেলে দিচ্ছে। সুতরাং শিক্ষার সাদামাটা দুর্নীতি বন্ধ করার আগে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ঠিক করা অপরিহার্য।      
শিক্ষা ক্ষেত্রের প্রথমেই সাদামাটা-সহজ দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এরপর হাত দিতে হবে অন্য দুর্নীতিতে। রাষ্ট্র তথা শিক্ষক এবং অভিভাবক মহল চাইলে ধীরে ধীরে সেসব দুর্নীতি থেকেও আমরা বের হয়ে আসতে পারব, তখন সমাজে ছড়িয়ে পড়বে শিক্ষার প্রকৃত আলো। এই সাদামাটা-সহজ দুর্নীতি রোধ না করে প্রচলিত বোধে যেগুলো দুর্নীতি সেগুলো সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে শিক্ষায় ছড়িয়ে পড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল, নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের অর্থ এবং নৈতিক দুর্নীতি দূর করতে না পারলে অন্যান্য দুর্নীতি সমাজকে কোণঠাসা করে রাখতে পারে।                   
স্বীকারোক্তি: জীবনের অনেকটা সময় এ লেখক নিজেও সাদামাটা-সহজ দুর্নীতি এবং সহজবোধ্য দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।  

মোহাম্মাদ আসাদ উজ জামান: শিক্ষক ও লেখক

আরও পড়ুন

×