ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

প্রতিক্রিয়া

মাতাপিতার প্রতি অবহেলা নয়

মাতাপিতার প্রতি অবহেলা নয়

ফাইল ছবি

মো. আবু শামীম আজাদ 

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০০

গত ৭ ডিসেম্বরের সমকাল সূত্রে জেনেছি, এক অসহায় বৃদ্ধ ও অসুস্থ পিতাকে তাঁর কন্যা ও জামাতা বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে না পেরে গজারি বনের মাঝে ফেলে রেখেছে। এই ঘটনা থেকে মানুষের অমানবিক ও বর্বরতার দিকটাই আমাদের সামনে উঠে আসে।  

পত্রপত্রিকায় এ ধরনের নিষ্ঠুর ঘটনা মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। শুধু সংবাদমাধ্যমে নয়, সামাজিক পরিসরেও বৃদ্ধ অসহায় পিতামাতার প্রতি সন্তানদের অমানবিক কর্মকাণ্ড দেখা যায়। আমরা এক সময় পিরোজপুরের পাড়েরহাট জমিদার বাড়ির আঙিনার মধ্যে অবস্থিত স্কুলের কোয়ার্টারে থাকতাম। আমাদের বাসার কাছেই এক বৃদ্ধ পিতামাতার বাস ছিল। তাদের দুটি ছেলে এবং হয়তো তিনটি মেয়েও ছিল। ছেলে দুটি মোটামুটি আর্থিকভাবে সচ্ছল। পিতামাতা বৃদ্ধ  হয়ে পড়েছেন। তারা কয়েকবার আমার মায়ের কাছে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাঁর ছেলেদের বিরুদ্ধে নালিশ দিয়েছিলেন। এক দিন এক  ভয়াবহ  ঘটনা শুনি।  বৃদ্ধ পিতামাতা সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় তাঁর বড় ছেলে তাদের মশারিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। 

চারপাশে এ ধরনের অনেক অমানবিক ঘটনা চোখে পড়ে। আমাদের ওষুধের দোকানের পাশে একটি কাপড় ধোলাইয়ের দোকান ছিল। লন্ড্রির মালিকের বৃদ্ধ পিতা মাঝেমধ্যে ছেলের অনুপস্থিতিতে দোকানে বসতেন। মাঝে মাঝে ছেলে বৃদ্ধ পিতার সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করত। এমনকি কোনো কোনো সময় পিতাকে শারীরিকভাবে অপদস্থ করত। 
পিতামাতার প্রতি সন্তানের এত নিষ্ঠুরতার কারণ কী? আমরা এ কথা কখনও ভাবি না কেন, আজকের আমি যে জায়গায় পৌঁছে গেছি, তার প্রধান কৃতিত্ব আমাদের পিতামাতার। তারা দয়া না করলে আমাদের এ পৃথিবীতে যেমন আসা হতো না, তেমনি ছোটবেলায় তারা যদি আমাদের প্রতি রহম না করতেন কিংবা যত্নশীল না হতেন তাহলে আমরা আমাদের বর্তমান অবস্থায় পৌঁছাতে পারতাম না। পৃথিবীর এমন কোনো ধর্ম নেই, যে ধর্ম পিতামাতার প্রতি দয়াশীল হতে বলে না। পিতামাতা যে বয়সেরই হোন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নশীল হওয়ার জন্য সব ধর্ম গুরুত্ব সহকারে তাগিদ দিয়েছে।
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ তাদের সন্তান। কোনো নারী-পুরুষ যখন পিতা বা মাতা হন, তখন পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ করে সন্তানের প্রতি তাদের মমত্ব জাহির করেন। তাদের এই মমত্বের কারণ কি ভবিষ্যতে সন্তানরা বৃদ্ধ  পিতামাতাকে ভরণপোষণ দেবেন? মোটেও তা নয়। কোনো পিতামাতা কখনও কোনো কিছুর আশায় সন্তানদের লালন-পালন করে না। সন্তান যখন ছোট থাকে তখন তার মুখে হাসি ফোটাতে পিতামাতার কত চেষ্টাই না থাকে! অথচ সেই পিতামাতা যখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হন, তখন তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতেও আমাদের সময় হয় না। আমরা কেন ভুলে যাই– একদিন পিতামাতার মতো আমরাও বৃদ্ধ হবো।  

একটি প্রচলিত কাহিনি দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। অনেক শীতের রাত। বাবা তার শিশু সন্তানকে দুটো  ছেঁড়া কম্বল দিয়ে বললেন, যাও কম্বল দুটো তোমার দাদাকে বারান্দায় দিয়ে আসো। শিশু সন্তান জানতে চাইল, এই প্রচণ্ড শীতে দাদা কেন বারান্দায়? বাবার সাফ উত্তর, ঘরের মধ্যে আর জায়গা নেই বলে বৃদ্ধ লোকটার বারান্দায় থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। শিশুটি দুটো কম্বলের একটা তার দাদাকে দিয়ে এসে বাবার কাছে বলল, একটা কম্বল সে তার দাদাকে দিয়ে এসেছে। তখন বাবা জানতে চাইল, বাকি কম্বলটা কি করেছ? তখন শিশুটি বলল, সেটা আমি তোমার জন্য রেখে দিয়েছি। তুমি যখন বুড়ো হবে আর দাদার মতো বারান্দায় থাকবে, তখন সেই কম্বলটি তোমাকে দেব। এই গল্প থেকেও যাতে আমাদের বোধোদয় ঘটে; পিতামাতার প্রতি সদয় হওয়া এবং তাদের যত্ন নেওয়া প্রত্যেক সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। 
 
মো. আবু শামীম আজাদ: জেলা ও দায়রা জজ, নারায়ণগঞ্জ
 

আরও পড়ুন

×