মানবসম্পদ
শিক্ষার কাজে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদেরই শোভা পায়

ফাইল ছবি
মো. সাব্বির হোসেন
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৮
স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও জাতি হিসেবে কাঙ্ক্ষিত অর্জন এখনও দূর অস্ত। বিভক্ত সমাজে অসৎ ও অনৈতিক আচরণের প্রবল উপস্থিতি আমাদের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। মনোবিজ্ঞান বলে, অপরাধ জন্মগত নয়; পরিবেশ ও শিক্ষাই মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সেই ভূমিকা পালনে ব্যর্থ। জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করাই যথেষ্ট– এই সত্য আমরা ভুলে গেছি। শিক্ষা শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নয়, বরং নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি বিকাশের জন্যও জরুরি। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব শিক্ষাক্রমে নৈতিকতার ঘাটতি রেখে গেছে। ফলে পুঁথিগত বিদ্যা বাড়লেও জীবনে দক্ষতা ও নৈতিকতার প্রয়োগ সীমিত রয়ে গেছে।
আমরা উচ্চশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে সক্ষম হলেও তাদের সমাজের প্রকৃত পরিবর্তনে ভূমিকা আজও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এর পেছনে মূল কারণ শিক্ষাক্রমের দুর্বল বিন্যাস, লক্ষ্য নির্ধারণে অস্পষ্টতা এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা। নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া সত্ত্বেও অতীতে শিক্ষাক্রমে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে কর্মক্ষেত্রে অসততা ও ক্ষমতার অপব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জাতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দেশে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম শুরু হলেও শিক্ষা সংস্কার উপেক্ষিত থেকে গেছে। শিক্ষা সংস্কার ছাড়া অন্য সংস্কারগুলো টেকসই করা সম্ভব নয়।
শিক্ষাক্রমের নকশা, গ্রাফিক্স, পেডাগগি, মূল্যায়ন, আইসিটি, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা, জীবন দক্ষতা, পরিবেশ, পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ– প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কমিটিতে একজন বা দু’জন শিক্ষাবিদ থাকলেও বাকি সদস্যরা প্রায়ই প্রশাসনিক কর্মকর্তা হন, যাদের অনেকেরই শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা নেই।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ক্যাডার বা নন-ক্যাডার পদে শিক্ষার গ্র্যাজুয়েটদের বাইরে থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া নায়েম, অধিদপ্তর, এনসিটিবিসহ বিভিন্ন শাখায় নিয়োগ বা সংযুক্তির জন্য এখানেও শিক্ষার বাইরে থেকে নিয়োগ পদায়ন করা হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শিক্ষার বিশেষ শাখায় বিশেষজ্ঞ না হওয়ায় সঠিকভাবে অবদান রাখতে পারেন না। পিটিআই, টিটিসি, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং টেকনিক্যাল টিচার ট্রেনিং কলেজ– এসব প্রতিষ্ঠানে এখনও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের নিয়োগ দেওয়া হয়, অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ পদে শিক্ষার গ্র্যাজুয়েটরা আবেদনই করতে পারেন না। এ এক পরস্পরবিরোধী বাস্তবতা। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের মূল কাজই হলো বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানকে শ্রেণিকক্ষে গঠনমূলক উপস্থাপনার উপযোগী করা। শিক্ষার ডোমেইনের বাইরে থেকে যারা নিয়োগ পান, তাদের পরে বিএড ও এমএড করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অথচ যারা শিক্ষায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী, তারা ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কোর্স সম্পন্ন করে এসেছেন। এ ক্ষেত্রে পিএসসি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচিত সমন্বয় সভা করে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।
অতীতের অভিজ্ঞতা ও গবেষণা থেকে জানা যায়, পূর্ববর্তী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত না করে ৭ থেকে ১৫ দিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগে প্রয়োজন প্রশিক্ষণের গুণগত মান এবং তার যথাযথ প্রয়োগ।
শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের দুটি পথ খোলা। এক. সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। দুই. নিয়োজিত শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। তবে একসঙ্গে এত সংখ্যক শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যার সমাধানে স্কুল চালু রেখেই সপ্তাহে দু’দিন স্কুলভিত্তিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ জন্য প্রতিটি স্কুলে একজন করে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তারা নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের তত্ত্বাবধান করবেন। এ ছাড়া অনলাইন ও অফলাইনে প্রশিক্ষণের সম্পূরক হিসেবে স্কুল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেটরের তত্ত্বাবধানে সেলফ-লার্নিং মডিউলারভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে প্রতিবছর ২০ হাজার শিক্ষকের মধ্যে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে।
অতীতে যেসব ব্যক্তি আমাদের টেক্সটবুক লেখার দায়িত্বে ছিলেন, তাদের দলীয় বিবেচনা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী মনোনীত করা হয়েছিল। ফলে টেক্সটবুকগুলো দুর্বল ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। বই রচনার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের আগ্রহী লেখকদের সুযোগ দিতে হবে, যাতে মানসম্পন্ন বিষয়বস্তু নিশ্চিত হয়। একইসঙ্গে এনসিটিবি একটি বিষয়বস্তু নির্দেশিকা তৈরি করবে, যা অনুসরণ করে বিস্তারিত বিষয়বস্তু লেখার কাজ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সম্পন্ন করলে একটি কার্যকর সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
মো. সাব্বির হোসেন: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
- বিষয় :
- মানবসম্পদ