পরিবেশ
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় হতাশার হাতছানি

ফাইল ছবি
আলা উদ্দিন
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫১
জলবায়ু সংকট বর্তমান বিশ্বে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা মানবজীবনে বিপজ্জনক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বের নানা অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংকটাপন্ন। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীনতা এবং বিশেষত শক্তিধর দেশগুলোর নিষ্ক্রিয়তা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে কপ২৯ সম্মেলন। এতে প্রভাবশালী বিশ্বনেতাদের অনুপস্থিতি এবং এ নিয়ে তাদের উদাসীনতা নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিশ্বনেতাদের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নিষ্ক্রিয়তা এবং তাদের বিতর্কিত মন্তব্য এই সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের অভাব স্পষ্ট করে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে দেশটির জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘটনা পরিবেশ আন্দোলনে একটি বড় ধাক্কা, যা বর্তমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সম্ভাব্য বাধা।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর উদাসীনতা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাস্তব সমাধান খুবই জরুরি। তবে এসবের জন্য দায়ী ধনী ও কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো। যেমন– যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা বা সংকট মোকাবিলায় কোনো সুস্পষ্ট পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এগুলো বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতারই প্রমাণ। সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যৌথ প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীলতা অপরিহার্য।
আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কিছু অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। উন্নত দেশগুলো জোগান দেওয়ার কথা ছিল ১৩শ বিলিয়ন ডলার, যা বহু দরকষাকষির পর কেবল ৩০০ বিলিয়ন ডলারের আশ্বাস দেওয়াটা সত্যিই হতাশাজনক। দৈনিক সমকালের সম্পাদকীয়তে যথার্থই বলা হয়েছে, ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের অনীহ পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সমাধানের অভাব দেখে নদী গবেষক শেখ রোকন এ সম্মেলনকে ঢাকার ভাষায় স্থানীয় ‘বাকুর ২৯ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ বলে অভিহিত করেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানে সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চল এবং নদীভাঙনে হাজার হাজার বাড়িঘর তলিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না হলে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে সংকট আরও গভীরতর হতে থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল, তা কি আদৌ বাস্তবায়িত হবে? অতীতেও বাংলাদেশে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় যে অর্থ এসেছে, তার ব্যবহারে কোনো স্বচ্ছতা দেখা যায়নি। বরং অনেক সময় দুর্নীতি ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে এসব অর্থ তেমন কার্যকর ফল দেয়নি। বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধি, খাদ্য ও পানি সংকট এবং উপকূলীয় জনগণের ব্যাপক বিপর্যয় এর প্রমাণ।
কিছু পরিসংখ্যান এবং বাস্তবতা তুলে ধরা যাক। গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল থেকে এসেছে, কিন্তু তার কোনো স্পষ্ট হিসাব নেই। এই অর্থ যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতো, তাহলে দেশের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেত।
বিশেষত উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে সমুদ্রের উচ্চতা ও ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে। এ ছাড়া রয়েছে পানি ও খাদ্যের অভাব, ভাঙন, খাদ এবং ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়া। এসব অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ বা অর্থের সঠিক ব্যবহার ঘটেনি। ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মান আরও খারাপ হয়েছে। যদি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতো, তাহলে এ সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
বাংলাদেশে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কার্যকর হয়নি। এসব পদক্ষেপ প্রায়ই জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বাইরে। সরকার যেসব প্রকল্প বা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা মূলত শহর-উপশহরের জন্য বেশি প্রযোজ্য। এগুলো গ্রাম, উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা যথাযথভাবে মোকাবিলা করছে না। ফলে উপকূলীয় এলাকার ভাঙন, পার্বত্য অঞ্চলের খাদ্য ও পানি সংকট এবং বন্যাজনিত সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। সরকারের উদ্যোগ প্রায়ই বড় বড় প্রকল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যেগুলো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় কোনো প্রভাব রাখতে পারছে না।
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় যা কিছু পদক্ষেপ, অভিযোজন, সহনশীলতা ও স্থানীয় উদ্যোগ, তার সবই মূলত ভুক্তভোগী মানুষের একান্ত নিজস্ব চিন্তাশক্তির ফসল। জনগণের প্রচেষ্টা কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না। একদিকে সরকারের কার্যকর উদ্যোগের অভাব; অন্যদিকে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবসৃষ্ট এ সমস্যা মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ জনগণের কল্যাণে আনতে হবে এবং দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বাস্তব পদক্ষেপ
নেওয়া জরুরি।
ড. আলা উদ্দিন: অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- জলবায়ু