মানবসম্পদ
শিক্ষাক্ষেত্রে এসডিজির লক্ষ্য পূরণে করণীয়

ফাইল ছবি
মাহমুদা খাতুন
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:১৫ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৫:৩২
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজিতে শিক্ষা অন্যতম। সেখানে মানসম্মত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সব শিক্ষার্থী যাতে প্রাসঙ্গিক, কার্যকর ও ফলপ্রসূ অবৈতনিক, সমতাভিত্তিক; সর্বোপরি গুণগত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে, তা নিশ্চিত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার জন্য অবশ্যই আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারিকুলাম বা সিলেবাসের বিষয়বস্তু শিক্ষাদান ও শেখার পদ্ধতিগুলো পুনর্বিবেচনা ও নবায়ন করতে হবে। গত বছর প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন আখ্যান ও সমান্তরাল বাস্তবতা: পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাবনা’ নামক পুস্তিকায় জানা যায়, আমাদের দেশে বর্তমানে শিক্ষায় কোনো আনন্দ নেই। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাস করার জন্য পড়ছে। শিক্ষক বা অভিভাবক, কেউই শিক্ষার্থীদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও উৎসাহ দেন না। কিছু ক্ষেত্রে উপরমহল থেকে শিক্ষার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর ফলে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার প্রকৃত মান বাড়েনি। সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কাঠামোর বৈষম্যের ফলে শিক্ষকরাও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। উপরন্তু বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব তো রয়েছেই।
তেমনিভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ক্ষেত্রেও ইনকোর্স নম্বর প্রদান ও খাতার অবমূল্যায়নের কারণে পরীক্ষার ফল ভালো হলেও মানের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাক্ষেত্রে কারিকুলামের অংশবিশেষ পরিবর্তন ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা যেমন ইংরেজি ও আইসিটিকে প্রাথমিক থেকে উৎসাহিতকরণ এবং মাধ্যমিকে বাধ্যতামূলক করা উচিত। নতুবা গোড়ায় গলদ রেখে অনার্স লেভেলে এগুলো বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।
এসডিজির অন্যতম অভীষ্ট মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই কোনো নজরদারি। শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানসম্মত করতে কলেজগুলোতে অনার্স পর্যায়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ছাত্রদের আধুনিক শিক্ষা উপকরণ; যেমন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের জন্য প্রয়োজনীয় স্মার্টবোর্ড, ডেস্কটপ, ই-লাইব্রেরি, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অডিটোরিয়াম যেখানে সেমিনার, কনফারেন্সের ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত বই সরবরাহ, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে ওঠানামার জন্য লিফট সুবিধা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে প্রেরণ ইত্যাদি কর্মসূচি বিদ্যমান। এ জন্য কলেজভেদে আড়াই কোটি থেকে ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই অভীষ্ট চার লক্ষ্যমাত্রা এবং এই নির্ধারিত সময় সম্পর্কে ছাত্রছাত্রী, এমনকি অনেক শিক্ষকও জানেন না। এসডিজির সম্পর্কে আরও বেশি প্রচার-প্রচারণা ও নজরদারি রাখতে হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানসম্মত করতে হলে প্রথমেই দরকার বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন। যেমন কারিগরি শিক্ষার অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষিত বেকারের হার অনেক বেড়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রী ২৫ বছর পড়াশোনার পর বেকার থাকার ফলে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী হতাশা থেকে মাদকে আসক্ত হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমাদের পাঠ্যক্রমগুলো এত দুর্বোধ্য ও বিরাটকায়; এগুলো পড়ে যুগোপযোগী বিষয়াবলি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া বড়ই কঠিন।
শিক্ষাক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর সফল বাস্তবায়নে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে ইন্টারেক্টিভ। সব পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে আনন্দদায়ক ও যুগোপযোগী করার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যেমন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। মোদ্দা কথা, শিক্ষা হতে হবে আনন্দদায়ক। ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনার ভীতি দূর করার জন্য শিক্ষকের মধ্যে হাসিখুশি মনোভাব থাকতে হবে এবং শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে, সে জন্য লার্নিং উইথ প্লেজার চালু করতে হবে।
সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম সহজ, জীবনঘনিষ্ঠ ও সময়োপযোগী হতে হবে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অর্থাৎ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি দূর করতে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত ও সহজ করতে হবে। পরীক্ষায় পাসের শর্তাবলি করতে হবে সহজ। যেমন কোনো বছর একজন ছাত্র এক বা দুটি বিষয়ে অকৃতকার্য হলে পরের বছর সব নয়, শুধু উক্ত বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেই চলবে। শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি জরুরি কারিগরি শিক্ষার প্রসার। এ শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে এবং বেকারত্ব কিছুটা হলেও ঘুচে যাবে।
উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আমাদের উচিত ছাত্র-ছাত্রীকে উৎসাহিত করা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আমাদের চিন্তা করতে হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এ জন্য গবেষণা, আউটসোর্সিংয়ের কাজ, গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং বিশ্বায়নের সঙ্গে মিল রেখে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মাহমুদা খাতুন: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজকর্ম বিভাগ, নারায়ণগঞ্জ কলেজ
- বিষয় :
- মানবসম্পদ