ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

মনমোহন সিং যেভাবে চ্যালেঞ্জিং কূটনীতি সামাল দিয়েছিলেন

মনমোহন সিং যেভাবে চ্যালেঞ্জিং কূটনীতি সামাল দিয়েছিলেন

সি. রাজা মোহন

সি. রাজা মোহন

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৩

মনমোহন সিং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ভারতের অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। ফলে বিশ্বমঞ্চে ভারতের উত্থান ঘটে। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ এক দশকে তাঁর ভূমিকা তুলনামূলক কম প্রশংসিত। অথচ এ সময় আঞ্চলিক শান্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব এগিয়ে নিতে তাঁর বৈদেশিক নীতি বেশ সহায়তা করেছিল।

২০০৫ সালের শুরুর দিকে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সিং ভারতের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সম্পর্কের তিনটিতে বড় অগ্রগতির পথে হাঁটার সুযোগ পেয়েছিলেন। এগুলো হলো ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক। তাঁর বিদেশ নীতির মূল গল্পটিই ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ২০০৫ সালের গ্রীষ্মে ও বসন্তকালে তিনটি রাষ্ট্রের সঙ্গে যে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেগুলো তাঁর মেয়াদের বাকি সময় কী রূপ নিয়েছিল তা। 

অনস্বীকার্য, তিনটি সম্ভাবনাই আবির্ভূত হয়েছিল অটল বিহারি বাজপেয়ির (১৯৯৮-২০০৪) অধীনে এবং তা পাকাপোক্ত হয় মনমোহন সিংয়ের সময়। সর্বোপরি পররাষ্ট্রনীতি একটি ধারাবাহিক সম্পর্ক, যা একটি সরকারের সঙ্গে শেষ হয় না এবং নতুন সরকারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় না। কিন্তু প্রতিটি সরকার বহির্বিশ্বের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে বিষয়ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় সামনে নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বদৃষ্টি, রাজনৈতিক ইচ্ছা ও অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য বিবেচনায় নেওয়া হয়। 
শেষ পর্যন্ত এটাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, আপনি যার সঙ্গে আলাপ করছেন তার ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সবকিছু আমাদের ওপর নির্ভর করে না। সুযোগগুলো ফলে পরিণত করার জন্য আলোচনায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব প্রয়োগে ইচ্ছুক এমন একজন ব্যক্তি প্রয়োজন। যদিও পাকিস্তান ও চীন ভারতের সঙ্গে অবিলম্বে শান্তির প্রয়োজনে একমত হতে পারেনি; ওয়াশিংটন দিল্লির সঙ্গে একটি নতুন ও বিস্তৃত সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল।

পি ভি নরসীমা রাও এবং বাজপেয়ি পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্নে নতুন কৌশল দিয়ে বাইরের বহু সংকট মীমাংসা করেছিলেন। এর মধ্যে বাজপেয়ির ১৯৯৮ সালের পাঁচটি পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল। উত্তরাধিকারসূত্রে একটি সুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যে সিং তিনটি কূটনৈতিক সম্পর্কে অগ্রগতি নিশ্চিত করেন। 
কংগ্রেস পার্টির ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বড় পদক্ষেপ নিয়ে একেবারেই অস্বস্তিতে পড়েছিল। এমনকি দলটি সিংকে পাকিস্তান সফরেও যেতে দেয়নি। দিল্লি ছিল বিক্ষিপ্ত। মোশাররফের ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করলে পরিস্থিতি ঝিমিয়ে আসে এবং ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইতে পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট সন্ত্রাসী হামলার পর পরিস্থিতি সংকটে রূপ নিলে পাকিস্তানের প্রতি আগ্রহ কমে আসে।  
২০০৫ সালের এপ্রিলে চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও দিল্লি সফর করেন। এ সময় দিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে অস্পষ্ট সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নীতি ও পরিসীমার ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি চুক্তি হয়েছে। 

কিন্তু বেইজিং চুক্তির বিধানের পুনর্ব্যাখ্যা শুরু করলে সীমানা নিষ্পত্তির আলোচনা শিগগির স্থগিত হয়ে যায়। যদিও ভারত মীমাংসার জন্য আগ্রহী ছিল, কিন্তু বেইজিং অনিচ্ছুক বলে মনে হয়েছিল। কারণ, ২০০০ সালের মাঝামাঝি থেকে চীনের ক্ষমতা দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল। এতে দুটি দেশের মধ্যে ক্ষমতার ব্যবধান দেখা দেয়। 
শি জিনপিংয়ের অধীনে চীন দিন দিন শক্তিশালী এবং রাজনৈতিকভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। সিংয়ের আমেরিকান গল্পটি খুব ভিন্ন এবং তাৎপর্যবহ। যদিও তিনি ২০০৯ সালে একটি বড় ম্যান্ডেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন; সিংকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন চুক্তি বাস্তবায়নে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সেই প্রকল্পে কংগ্রেস নেতৃত্বের তেমন রাজনৈতিক আগ্রহ ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের ভার উত্তোলন করার জন্য নরেন্দ্র মোদির সরকারের প্রয়োজন ছিল, যিনি লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা উপভোগ করেছিলেন; তাঁর দলের পররাষ্ট্রনীতির ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন।

তবে সিং যদি ২০০৮ সালে প্রয়োজনে তাঁর মুকুটটি বিসর্জনের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কাজ না করতেন, তাহলে মোদি সরকারের জন্য গত দশকজুড়ে মার্কিন সম্পর্ককে দ্রুত পরিবর্তন করা আরও কঠিন হয়ে যেত। যেটি অবশ্যই সাহসী ও আরও আত্মপ্রত্যয়ী ছিল।
ব্যাপক রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আমলাতান্ত্রিক বৈরিতার মধ্যে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের মোড় ফেরানোর প্রবণতা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলগত উত্তরাধিকারের ধারা হিসেবে থেকে যাবে। এটি ১৯৯০-এর দশকে ভারতের অর্থনৈতিক উত্থানে তাঁর ভূমিকার পরিপূরক ও শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। 
সি. রাজা মোহন: লেখক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের
আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
থেকে ঈষৎ সংক্ষিপ্ত ভাষান্তরিত

আরও পড়ুন

×