জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে কিছু কথা

আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪২
জুলাই ‘বিপ্লব’-এর পর দেশে এখন সংস্কারের দামামা। সংবিধান থেকে শুরু করে হেন কিছু নেই, যা সংস্কারের আওয়াজ ওঠেনি। জনপ্রশাসন সংস্কারেরও আওয়াজ তুলেছে কেউ কেউ। এ জন্য কমিশন হয়েছে। সেই কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল ডিসেম্বরের শেষ তারিখে; কিন্তু এরই মধ্যে কিছু সুপারিশ খোদ কমিশন প্রধানই ফাঁস করে দিয়েছেন। তা নিয়ে ২২ তারিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হয়েছে নজিরবিহীন এক বিক্ষোভ, যা জনপরিসরে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
আমাদের দেশের জনপ্রশাসন প্রায় আড়াইশ বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল। এই দীর্ঘ সময়ে জনপ্রশাসনে পরিবর্তন এসেছে নানাভাবে।
জনপ্রশাসন প্রথমদিকে ছিল শুধু কৃৎভিত্তিক। সিভিল সার্ভিস, ফরেন সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস, রেলওয়ে সার্ভিস, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিস, কাস্টমস সার্ভিস, ট্যাক্সেশন সার্ভিস। গত শতকের আশির দশকে আরও কিছু খাত জুড়ে দিলে ব্র্যাকেটবন্দি হয়ে যায় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস। ব্র্যাকেটে বন্দি হলো প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, অমুক, তমুকসহ ২৯টি ক্যাডার, কিছু একীভূত হয়ে এখন সংখ্যাটা ২৬।
ক্যাডার বাছাই হয় কী করে? আবেদনের সময় প্রার্থী তাঁর পছন্দের ক্রম হিসাবে বিভিন্ন পদের নাম উল্লেখ করেন। সচরাচর প্রথম দিকের পছন্দ থাকে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, কর ও অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস। সব পরীক্ষার্থী আশায় থাকেন এই ৬টি ক্যাডারে পদ লাভের। অবশিষ্ট ক্যাডারগুলোর পছন্দের ক্রম থাকে তার পরে। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর মেধাক্রমের ভিত্তিতে পছন্দের ক্রমের অগ্রাধিকার হিসেবে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্যাডারে ন্যস্ত করা হয়। সাধারণত যারা মেধাক্রমের ওপরের দিকে থাকেন, তারা বর্ণিত ৬টি ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হন। তবে কেউ কেউ পছন্দক্রমে অন্যান্য ক্যাডারকে প্রাধান্য দিলে তিনি ৬ ক্যাডারে ঢোকার যোগ্যতা থাকার পরও অন্য ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হন। বিসিএসে নিয়োগের সময় প্রার্থীর মেধা ও পছন্দের ভিত্তিতে ক্যাডার বিলিবণ্টন হয়।
চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর শুরু হয় নবীন কর্মকর্তাকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করার পদক্ষেপ। যিনি যে ক্যাডারে নিয়োজিত হন, তাঁকে সেই ক্যাডারের শীর্ষ পদের উপযোগী করে তৈরি করা হতে থাকে। পুলিশের এএসপি পদে যিনি যোগদান করেন, তাঁকে গড়ে তোলা হয় ভবিষ্যতের আইজিপি হিসেবে একজন ভালো পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার লক্ষ্যে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদানকারীকে ভালো কূটনীতিক, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস কর্মকর্তাকে দক্ষ হিসাববিদ, কৃষিবিদকে শ্রেষ্ঠ কৃষি বিশেষজ্ঞ হিসেবে। এমনি করে প্রত্যেক কর্মকর্তাকে তৈরি করা হয় ভবিষ্যতের জন্য, নিজ নিজ ক্যাডার তথা তাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে। তেমনিভাবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তৈরি করা হয় ভালো প্রশাসক হওয়ার জন্য।
এ কারণেই আশির দশকের আগে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদগুলো ছিল প্রশাসনেরই। কিন্তু আশির দশকে এসে বিধান চালু হলো উপসচিব পদে ৭৫ ভাগ প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদোন্নতি পাবে আর ২৫ ভাগ পদোন্নতি পাবে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। যুগ্ম সচিব পদে এই অনুপাত ছিল ৭০:৩০। সম্প্রতি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির এ অনুপাত হবে ৫০:৫০। সেই সঙ্গে কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা দিতে হবে।
চাকরির প্রথম দিকে যখন সবাই প্রায় প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকেন তখন প্রথম দুই বছরের মধ্যে ৩০০ নম্বরের তিন পেপার পরীক্ষা দিয়ে চাকরি স্থায়ী করতে হয়। চাকরি স্থায়ী হওয়ার পরে চার বছরের মধ্যে সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা দিতে হয় ৪০০ নম্বরের ৪ পেপারের। এরপর নানাজন বিভিন্ন কর্মস্থলে চাকরি করতে থাকেন। কর্মক্ষেত্রে আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে না। যদি চাকরির ১৫-১৬ বছর পরে পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা দিতে হয় তাহলে কৃৎভিত্তিক কর্মকাণ্ড ছেড়ে পরীক্ষা প্রস্তুতিতেই তাদের সময়ক্ষেপণ করতে হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেবাপ্রত্যাশী জনসাধারণ।
দ্বিতীয়ত, মেধার ভিত্তিতেই চাকরির শুরুতে ক্যাডার নির্ণীত হয়ে থাকে। মেধাক্রমে পেছনে পড়ে থাকা কাউকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দিতে মেধাক্রমের সামনে থাকা কাউকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই ন্যায়বিচারের অংশ হতে পারে না। প্রশাসন ক্যাডার ভিন্ন অন্য ক্যাডারের কাউকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হলে সেই কর্মকর্তা চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর তাঁর পেছনে যে প্রশিক্ষণ ও গড়ে তোলার জন্য পরিশ্রম করা হয়েছে, সবই পণ্ডশ্রম হয় বৈকি।
সর্বশেষে যে কথা বলার তা হচ্ছে, জনপ্রশাসনের সংস্কার একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ মুহূর্তে জাতি নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মধারাগুলোর সংস্কার শেষে দ্রুত একটি নির্বাচন চায়। সরকারপ্রধানও ইঙ্গিত দিয়েছেন বছর দেড়েকের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে। জাতীয় নির্বাচন শেষে রাজনৈতিক সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলে তা হবে বাস্তবানুগ। খামোখা অস্থির সময়ে স্থির
জনপ্রশাসনকেও অস্থির করে তুললে শুধু পানি ঘোলা হতে পারে, যেখানে কে কী মাছ ধরল ঠাহর করা মুশকিল হয়ে যাবে। অতএব জনপ্রশাসনকে অস্থির করে তুলতে পারে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এমন কাজ আপাতত স্থগিত রাখাই শ্রেয়।
যদি জনপ্রশাসন সংস্কারের কাজটি এখনই করা দরকার হয় তাহলে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, কর ও অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস এই ৬টি ক্যাডারকে সিভিল সার্ভিসে রেখে বাকি
ক্যাডারগুলোকে জুডিশিয়াল সার্ভিসের মতো যার যার সার্ভিস করে দেওয়াই ভালো। ওই ৬ ক্যাডারকে নিয়ে শুরু হোক নতুন বাংলাদেশের পথযাত্রা; শক্তিশালী হোক বাংলাদেশের জনপ্রশাসন।
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
- বিষয় :
- মানবসম্পদ