ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘তত্ত্বাবধান’ হবে কীভাবে?

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘তত্ত্বাবধান’ হবে কীভাবে?

মইনুল ইসলাম

মইনুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৫৯ | আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:০০

বাংলাদেশে ফিরে আসছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য গত সেপ্টেম্বরে ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে কমিশন ঘোষিত এবং অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে অন্য সদস্যদের মনোনয়ন সম্পন্ন হয়েছিল। কমিশন জানুয়ারির মাঝামাঝি তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশ করবে বলে সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে। এর আগেই, গত ডিসেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এসেছে। সুতরাং আগামী নির্বাচন আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে– ধরে নেওয়া যায়। 

অবশ্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার সংক্রান্ত কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন রূপরেখা প্রস্তাব করতেই পারে। সে ক্ষেত্রে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬ সালে এই ব্যবস্থা কীভাবে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের মারাত্মক ম্যানিপুলেশনের শিকার হয়েছিল, সে ইতিহাস পর্যালোচনা জরুরি। ২০০৭ সালে ‘ওয়ান ইলেভেন’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে দুই বছর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করেছিল, সেটাও পর্যালোচনার বাইরে থাকতে পারে না। 

১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে দেখা গিয়েছিল, সাংবিধানিকভাবেই রাষ্ট্রপতিকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী করে ফেলা হয়েছে। এর মারাত্মক কুফল জাতিকে চরম বিপদে ফেলেছিল অন্তত দু’বার। প্রথম ঘটনায় দু’জন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া নিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ও সেনাবাহিনী প্রধান আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমের মধ্যে বিরোধ এবং বিদ্রোহের আশঙ্কা দেখা দেয়। জাতির সৌভাগ্যক্রমে বিচারপতি হাবিবুর রহমান প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে ওই বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ঘটনা, ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হলেও বিএনপি কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ধারণা করা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ পেলে ছোট কয়েকটি দলের সমর্থন নিয়ে জোট সরকার গঠন সম্ভব হবে। কিন্তু নির্বাচনী ফল ঘোষণার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ না জানানোয় ভয়ানক রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। কয়েকজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য সংকটটি শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন।
২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হজব্রত পালন করতে গিয়ে মদিনা নগরীতে অবস্থানকালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেয়াদপূর্তির ছয় মাস আগেই মার্চ মাসে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে বসেন। কিন্তু দেশে ফিরে সেই ঘোষণা থেকে তিনি পিছিয়ে যান। ধারণা করা হয়, মার্চে নির্বাচন দিলে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, আর পরে দিলে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হবেন। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়জনকেই অধিকতর নিরাপদ বিকল্প মনে করেছিল। কিন্তু দেখা গেল, নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ায় বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন– তিনিই পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা, তখন ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেক আগেই কথিত ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করে দেন। যে কারণে শপথ নেওয়ার রাতেই তিনি আওয়ামী লীগের সাজানো মাঠ প্রশাসন রদবদল ও গণবদলির মাধ্যমে তছনছ করে দেন। আওয়ামী লীগ ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ করতে চেয়েছিল ঠিকই; কিন্তু ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে দেড় শতাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করে, সেটাও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রতিষ্ঠার অন্তরায় ছিল। কারণ, ওই পদগুলোতে যাদের আনা হয়েছিল, বেশির ভাগই ছিল বিএনপি-জামায়াতপন্থি। 

আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট আর ঝুঁকি নিতে চায়নি। ২০০১-০৬ শাসনামলের প্রথম থেকেই সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক আনুগত্য নিশ্চিত করায় মনোযোগী হয়। জ্যেষ্ঠতাক্রম লঙ্ঘন করে জেনারেল মইন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করা হয়। জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত না করার ‘অপরাধে’ ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য এবং আরও অনুগত অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স দু’বছর বাড়িয়ে ৬৭ বছর নির্ধারণ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির প্রাথমিক পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসানকে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার অঙ্ক কষেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর ফলে আওয়ামী লীগ শুরু করে হাসানবিরোধী আন্দোলন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিচারপতি হাসান প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে তাঁর অসম্মতি জানালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বিধান অনুসারে বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীকে অনুরোধ না জানিয়ে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন। পরে তাঁর নানা কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে উপদেষ্টা পরিষদের চারজন সদস্য পদত্যাগ করেন। এতৎসত্ত্বেও নতুন চারজন উপদেষ্টা নিয়ে ইয়াজউদ্দিন ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এগিয়ে যেতে থাকলে দেশজুড়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ বঙ্গভবনে গিয়ে জরুরি অবস্থা জারির জন্য রাষ্ট্রপতিকে কার্যত বাধ্য করেন। পরদিন ১২ জানুয়ারি ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মিডিয়ায় সেটা ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সরকার নামে পরিচিতি পায়। দৃশ্যত আরও দীর্ঘ সময় শাসনের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তিন মাসের স্থলে প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

মূল বক্তব্যের প্রয়োজনেই ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চাতুর্যপূর্ণ চাল-পাল্টা চালের কাহিনি বর্ণনা করতে হলো। এটা স্পষ্ট যে, প্রতিবারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ‘ম্যানিপুলেশন’ করা হয়েছে। এমনকি ওই ব্যবস্থা বাতিল নিয়েও প্রশ্ন ছিল। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায়ে ঘোষণা করেন– অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক; কিন্তু প্রয়োজনে আরও দুটো নির্বাচন ওই ব্যবস্থায় হতে পারে। কিন্তু সুযোগ বুঝে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দেন শেখ হাসিনা। ফলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি নির্বাচনই একতরফা নির্বাচনী প্রহসনে পর্যবসিত হয়। ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচনের আগের রাতেই পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরিয়ে রাখে। পরপর তিনটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র বরবাদ করে শেখ হাসিনা নিজেই গণঅভ্যুত্থান ডেকে আনেন। এখন, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ভবিষ্যতের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ‘তত্ত্বাবধান’ যাতে অতীতের অনুরূপ ম্যানিপুলেশনের শিকার না হয়– সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যদি রাষ্ট্রপতির অধীনে থাকে, তাহলে আবদুর রহমান বিশ্বাস বা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের আমলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যাতে আগেভাগেই নির্দিষ্ট হয়ে লতিফুর রহমানের আমলের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটান, সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। বড় কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ কোনোভাবেই যেন ৯০ দিনের বেশি বাড়ানো না যায়।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে 
পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, 
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

আরও পড়ুন

×