ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ইসলাম ও সমাজ

ইসলামের জ্ঞানপিপাসু নারী

ইসলামের জ্ঞানপিপাসু নারী

কোলাজ

মেহেরুন নেছা রুমা

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৬:৪৬

নব্যুয়ত-পূর্ববর্তী জাহিলিয়াতের সময়ে যে সমাজে কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়ার প্রচলন ছিল; কন্যাসন্তান জন্মের সংবাদে পিতারা অসম্মান বোধ করতেন। নব্যুয়ত-পরবর্তী সেই সমাজেই দেখা যায় কন্যাদের হাতে জ্ঞানের চাবিকাঠি তুলে দিচ্ছেন পিতারা। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে কোরআন এবং ইসলামী জীবনযাপনের পদ্ধতি শিক্ষালাভের জন্য নারীরাও এগিয়ে এসেছেন; প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছেন। সত্য প্রকাশে কখনও কাউকে ভয় পাননি। 

হিজরি প্রথম ও দ্বিতীয় শতক ইসলামের সর্বোত্তম ও স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই সময়টি ছিল সাহাবিদের সময়। নবীজির (সা.) মুখনিঃসৃত বাণী সাহাবিরা অন্তরের মাঝে গেঁথে নিতেন। রাসুলুল্লাহর (সা.) ওফাতের পর যখন হাদিস সংকলন এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখন সাহাবিদের মধ্য থেকে প্রত্যেকেই নানাভাবে সেই কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই হাদিস চর্চা করতেন।

প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরি শতকে নারীদের বর্ণিত অনেক হাদিস বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থগুলোয় লিপিবদ্ধ হয়, যা থেকে মানুষ এখনও শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে। 
হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে সাহাবিদের (নারী-পুরুষ) মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন আয়েশা (রা.)। তিনি ২ হাজার ২১০টি হাদিস বর্ণনা করেন। এর মধ্যে ২৯৭টি হাদিস বুখারি ও মুসলিমে স্থান পেয়েছে। ছয়টি হাদিস গ্রন্থে বেশিসংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারীর মধ্যে তাঁর স্থান দ্বিতীয়। আবু হুরায়রার (রা.) পরেই তাঁর স্থান।
আয়েশার (রা.) পর বেশি হাদিস বর্ণনাকারীর মধ্যে ছিলেন উম্মে সালামা (রা.)। তিনি ৩৭৮টি হাদিস বর্ণনা করেন। এ ছাড়া আসমা বিনতে ইয়াজিদ ইবনুস সাকান, উম্মুল মুমিনিন মাইমুনা, উম্মুল মুমিনিন হাফসা, আসমা বিনতে আবু বকর, আসমা বিনতে উমাইস, আমারা বিনতে আব্দুর রহমান (রা.)-সহ অনেক নারী সাহাবি হাদিস বর্ণনা করেছেন।

সাহাবিদের মধ্যে, হোক তিনি পুরুষ কিংবা নারী; সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে শিক্ষার্থীরা সুদূর ইরাক ও সিরিয়া থেকে মদিনা ভ্রমণ করতেন। মুহাদ্দিসাত ফাতিমা আল বাতাইহিয়া সিরিয়া থেকে মদিনায় এসে মসজিদে নববিতে পড়াতেন। তাঁর কাছে বড় বড় আলিম পড়তেন।

সেই সময়ে নারীরা ফতোয়া দিতেন, বিচারকাজ করতেন, সাক্ষ্য দিতেন, হাদিস মুখস্থ ও লেখার কাজ করতেন। প্রায় প্রতিটি ঘরে নারীরা কোরআন মুখস্থ করতেন। কোরআন ও হাদিসের যে কোনো ব্যাপারে ব্যাখ্যা জানতে সাহাবিরা আয়েশার (রা.) কাছে হাজির হতেন। তাঁর ফতোয়ার ওপর সবাই আস্থা রাখতেন।

ওই সময়ে নারী শিক্ষকরা মসজিদ, ফলের বাগান, নিজেদের ঘর, হাদিসের মজলিসে শিক্ষা দিতেন। তাদের কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করতেন বিশিষ্ট আলিম থেকে শুরু করে সাধারণ নারী-পুরুষ। যে নারী জ্ঞানের আলোয় নিজেকে রাঙাননি, তিনি কোনো কল্যাণ লাভ করেননি।

হাজার বছর আগে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত বিকশিত হয়নি, সেই সময়ে নারীরা জাগতিক যশ, খ্যাতি, দুনিয়ার প্রাচুর্য কিংবা ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষায় জ্ঞানসমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। বরং আখিরাতের প্রাচুর্যের আকাঙ্ক্ষায় তারা দীনি জ্ঞান অর্জন করেছেন, সেই অনুযায়ী আমল করেছেন এবং অন্যকে শিক্ষা দিয়েছেন। এতে তারা দুনিয়াতেও যেমন সম্মানিত হয়েছেন, আখিরাতেও তারা তাদের প্রতিদান পাবেন ইনশাআল্লাহ। 

নারীর বই পড়া মানে পুরো একটি পরিবারের বই পড়া। তখন নারীর জ্ঞানার্জনে কেউ কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং পিতারা নিজ নিজ কন্যাদের হাদিসের ক্লাসে নিয়ে যেতেন। কেউ পিতার কাছ থেকেই শিক্ষা নিতেন। কেউ পিতাকে জ্ঞানার্জনে সহায়তা করতেন।

অনেক নারী মুহাদ্দিসাত থেকে শিক্ষা নিয়েছেন তাদের পিতা, তাদের স্বামী, তাদের ভাই। অনেক আলেম কোনো বিষয়ে জটিলতায় পড়লে স্ত্রীর কাছ থেকে সমাধান পেতেন। সেসব স্ত্রী ছিলেন জ্ঞানের আধার। এমন অনেক মুহাদ্দিসাতকে তাদের পিতা ধনাঢ্য কারও কাছে বিয়ে না দিয়ে জ্ঞানী ছাত্রদের কাছে বিয়ে দিতেন, যাতে তাদের কন্যাদের জ্ঞানার্জন অব্যাহত থাকে। 

ইসলামের স্বর্ণযুগের মতো জ্ঞানপিপাসু সেই নারীদের আজ বড় প্রয়োজন। সাজসজ্জার চেয়ে জ্ঞানার্জনে নারীরা গুরুত্ব দিলে পরিবার ও সমাজের পরিবর্তন হতে পারে।

মেহেরুন নেছা রুমা: লেখক 
 

আরও পড়ুন

×