ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

উল্টোরথ

ছাত্র ঐক্যে ফাটলের নেপথ্যে

ছাত্র ঐক্যে ফাটলের নেপথ্যে

এহ্সান মাহমুদ

এহ্সান মাহমুদ

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০০:১২ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০০:২১

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ছয় বছর আগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই সঙ্গে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। এর জের ধরেই তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। 

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেখানেও আন্দোলনকারীদের মিছিল, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ও স্লোগানে আবরার ফাহাদের নাম উঠে এসেছে বারবার। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের সময় যে কয়েকটি ঘটনায় দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড তার অন্যতম। চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দেশের সক্রিয় সব ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য’ যেভাবে গঠন করেছিল, সেটি ছিল অভাবনীয়। দুঃখজনক হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পতনের পর অতি দ্রুতই ছাত্র ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন সময় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলো। 
সর্বশেষ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-কুয়েটে সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাড়ছে উত্তেজনা। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দায়ী করে প্রকাশ্যে বক্তব্যও দিচ্ছে। হামলার জন্য ছাত্রদলকে দোষারোপ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিপরীতে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ছাত্রদের একাংশ বাধা দিলে এমন ঘটনার সূত্রপাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ক্যাম্পাসগুলোয় প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করছে বলেও মন্তব্য করা হয়। 
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান চলাকালে এসব ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে। অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। সংগঠন হিসেবে ছাত্রদল শহীদের সংখ্যায় এগিয়ে। ফ্যাসিস্টবিরোধী শক্তির অন্যতম নিয়ামক এসব ছাত্র সংগঠন ভবিষ্যৎ ছাত্র রাজনীতির কর্তৃত্ব ধরে রাখাসহ বহুমুখী রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক স্বার্থে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে। যেখানে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিচার এখনও নিশ্চিত করা যায়নি, এরই মধ্যে এ ধরনের সংঘাত শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়; এর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের সর্বনাশের পদধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। 

কুয়েটে সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এসব কর্মসূচি থেকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা যায় ছাত্র সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে নতুন করে সংঘর্ষে জড়ানোর শঙ্কাও দেখা দেয়। 

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদের মধ্যে শিশু-কিশোররাও সংখ্যায় অগ্রগণ্য। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে বেধড়ক পিটুনি খেয়েছে কিশোর ইব্রাহিম। তাকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছেন সেনাসদস্যরা। সেই কিশোরকেই আটক করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রিজন সেলে পাঠিয়েছে পুলিশ। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় আহত কিশোরকে প্রিজন সেলে আটকে রাখার ঘটনা খুবই মর্মন্তুদ। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে কুয়েটের প্রধান ফটকের সামনে মারধর করা হয় ইব্রাহিমকে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েক শিক্ষার্থী কিশোরকে পেটাচ্ছেন। এক সেনাসদস্য রক্তাক্ত অবস্থায় কিশোরকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। সে অবস্থায়ও তাকে আঘাত করা হচ্ছে। কিশোর ইব্রাহিমকে কারা লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছে? ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যে স্পিরিট, তার সঙ্গে এই দৃশ্য একেবারেই বেমানান। এমন দৃশ্য বড়ই হৃদয়বিদারক। 
ইতোমধ্যে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা পেলে শিক্ষার্থীদের আজীবন বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিলের পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মকর্তা- কর্মচারীরাও কোনো ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না; বলা হয়েছে। এ ছাড়া ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
ধারণা করা হয়েছিল, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর জাতীয় রাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হবে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে আশঙ্কা, পরিবর্তন কি অধরাই থেকে যাবে? 

গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধে এমনটা করা হয়েছে। এখানে খেয়াল করার বিষয় হলো, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামনে আসা নতুন ছাত্র নেতৃত্ব একদিকে বলছে, আমরা ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি চাই না; আমাদের চাওয়া, ছাত্র সংসদভিত্তিক গঠনমূলক রাজনীতি। অন্যদিকে তারাই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের তোড়জোড় করছে। ৫ আগস্টের পরে একই ছাতার নিচ থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এবং ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ বের হয়েছে। এখান থেকেই নিজেরা ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে আলাদা নামে হাজির থাকছে। তাই তাদের মুখে ‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি’ শব্দটি সত্যের অপলাপ। কেননা, যখন তারা নিজেরাই একদিকে মূল রাজনৈতিক দল হিসেবে পারফর্ম করার জন্য তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে ক্যাম্পাসে সংগঠিত হয়ে দল গঠন করছে। এমন বাস্তবতায় পুরোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। 

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রলীগও লাপাত্তা। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ক্যাম্পাসগুলোতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে– এটা অনুমেয় ছিল। এটা করতে গিয়ে ছাত্রদল এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠন ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এই সংঘাতের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে এর মূলে রয়েছে একদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জাতীয় রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ঘিরে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা। 

আগামী নির্বাচন ঘিরে সাম্প্রতিক যে বিতর্ক, সেখানে দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। দ্বিতীয়টি, জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন। আমরা যদি শেষের বিতর্কটি লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব, এই মুহূর্তে এ আলাপ কেন সামনে আনা হয়েছে? এর কারণ খুঁজে পেলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন সহিংস ঘটনা ঘটছে, তা পরিষ্কার হবে। এ মুহূর্তে ছাত্রদলের যে আশঙ্কা– ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র ব্যানারে শিবির ও বৈষম্যবিরোধীরা সংগঠিত হচ্ছে। তার কারণও তখন স্পষ্ট হয়ে আসবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে শামিল থাকা ছাত্র ঐক্যে ফাটল ধরবে– এটাও অনুমেয় ছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দল গঠনের আগেই নতুন রাজনৈতিক দলের ছাতার নিচে অবস্থান করা এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক চাতুর্যে পরিণত হলে তা হবে আরও হতাশার।  

এহ্‌সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন

×