উচ্চারণের বিপরীতে
গণঅভ্যুত্থানের সামাজিক শক্তি ও বর্তমান অংশীদারিত্ব

মাহবুব আজীজ
মাহবুব আজীজ
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫ | ০০:২৯ | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৫ | ০০:৩০
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে অদৃশ্যপূর্ব সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, হানাহানি ও সংশয় দেখে এ দেশের মানুষ অভ্যস্ত; চব্বিশের জুলাইতে তা ভেঙে পড়ে। অবশ্য জুলাই গণঅভ্যুত্থান কোনোভাবেই রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রিত বা নেতৃত্বাধীন ছিল না; এটি সংগঠিত হয় ছাত্রদের নেতৃত্বে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের ৫ জুন শুরু ছাত্র আন্দোলন এক মাসেই বিপুল আকার ধারণ করে। এতে যুক্ত হতে থাকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ– পোশাক শ্রমিক থেকে রিকশাওয়ালা, পানের দোকানদার থেকে ফেরিওয়ালা। শুধু কোটা সংস্কারের দাবি নয়; প্রত্যেকে নিজ নিজ বঞ্চনার দাবি নিয়ে যুক্ত হতে থাকে ছাত্রদের মিছিলে। রাজধানী থেকে জেলা-উপজেলা; আন্দোলন ছড়িয়ে যায় সারাদেশে।
প্রথমে সরকার পতনের আহ্বান ছিল না ছাত্রদের সমাবেশে। কিন্তু ১৬ জুলাই থেকে কঠোর দমনপীড়ন শুরু হলে মানুষ একদিকে যেমন প্রতিরোধ গড়তে শুরু করে, তেমনি দেড় দশকের দমবন্ধ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। ছাত্র-জনতার বুকে পুলিশের গুলি যত ছোটে, আন্দোলনের রূপ তত দ্রুত বদলে যায়; সরকার পতনের এক দফা দাবি সামনে আসে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখবার জন্য সরকার নিজের দেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে– শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ; এই অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা দেশের সব সামাজিক শক্তিকে এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করিয়ে দেয়; প্রতিরোধের ইস্পাত-দৃঢ় মনোবল নিয়ে তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ব্যূহ তৈরি করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ২, ৩ ও ৪ আগস্টে আন্দোলন সরাসরি শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনে এক দফা দাবিতে আর সীমাবদ্ধ থাকে না। আন্দোলনের মঞ্চ থেকে উচ্চারিত হয়–এমন এক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাই, যেখানে শেখ হাসিনার মতো কর্তৃত্ববাদী শাসক আর আবির্ভূত হতে পারবেন না! মূল জাগরণের আগে স্পষ্ট হতে থাকে– যূথবদ্ধ সামাজিক শক্তি এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একমত, যেখানে সব নাগরিকের সমান অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে; যেখানে সরকার কোনো কারণেই দমনপীড়নের কৌশল নিতে পারবে না।
২.
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার সমান্তরালে অর্জন বা অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের দুই সপ্তাহ পরে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা খাত এবং তথ্যপ্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে।’
গত ১ জুলাই ২০২৫ গণঅভ্যুত্থান পুনরুত্থান কর্মসূচির উদ্বোধন করে ড. ইউনূস বলেন, ‘জুলাই ছিল দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক অমোঘ ডাক, জনতার এক জাগরণ। সেই আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল ফ্যাসিবাদের বিলোপ করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ, রাষ্ট্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।’ স্বৈরাচার যেন কখনও ফিরে আসতে না পারে, সে ব্যাপারে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি (সমকাল, ২ জুলাই ২০২৫)। এক বছর দূরত্বে দাঁড়িয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে পরিবর্তন দেখতে না পেলেও এ বিষয়ে সরকারি তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন করতেই হয়।
২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে অল্পকালের মধ্যে সরকার মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এ ছাড়াও গঠন হয় গুম কমিশন ও ব্যাংক খাত টাস্কফোর্স। সংস্কার কমিশনগুলোর কাজ চূড়ান্তভাবে সমন্বয় করে জাতীয়ভাবে একমতে পৌঁছুনোর লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, যার সভাপতি ড. ইউনূস নিজে; প্রবাসী অধ্যাপক আলী রিয়াজ এর সহসভাপতি। সংস্কার নিয়ে যে কর্মকৌশল সরকার গ্রহণ করে, তাতে গণঅভ্যুত্থানের মূল সামাজিক শক্তির অনুপস্থিতি পূর্বাপর দেখা গিয়েছে। দেশের বাইরে দীর্ঘকাল চাকরিরত বিশেষজ্ঞদের এনে তাদের পৌরোহিত্যে ৩০-৩৫টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে ঐকমত্যে পৌঁছুনোর প্রয়াসও চলছে। এর মধ্যে অধিকাংশ নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সব দলের সব বিষয়ে একমত হওয়া অবাস্তব চিন্তা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাতেই এর সমাধান সংগত।
ওদিকে একের পর এক অপ্রয়োজনীয় ইস্যু সামনে এনে ‘চায়ের কাপে ঝড়’ তুলছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলের কাছে ফর্দ পাঠানো, টিক চিহ্ন নিয়ে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে জাতির সামনে তুলে ধরে জানানো– কোন দল কোনটিতে রাজি নয় ইত্যাদি প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর ন্যূনতম প্রসঙ্গগুলোতে আলোচনা ও উদ্যোগ সীমাবদ্ধ করলেও সুফল পাওয়া সহজ হয়। সুনির্দিষ্ট সময় পরে জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন, নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার রোধ, প্রার্থী মনোনয়নে অপরাধী ও কালো টাকার মালিকদের অযোগ্য ঘোষণাসহ নির্বাচনী শৃঙ্খলা বিধিবিধান অমান্য করলে সুস্পষ্ট শাস্তির বিধান প্রসঙ্গে সকল রাজনৈতিক দলের একমত না হওয়ার সুযোগ নেই। এসব বিষয়সহ ইতোমধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে মতৈক্য ও ১০ বছরের বেশি এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন সামনে নিয়ে জুলাই চার্টার ঘোষণার মাধ্যমে সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনী কার্যক্রম ঘোষণা করা।
৩.
গণঅভ্যুত্থানের সামাজিক শক্তিকে পাশ কাটিয়ে প্রবাসীদের পৌরোহিত্যে লাগাতার সংস্কার বৈঠক প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ থেকে সরকার সাধারণ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করবার সুবর্ণ সুযোগ হারাচ্ছে। সংস্কার কমিশনে ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে জোর আলোচনা করছেন বিশেষজ্ঞবৃন্দ। কিন্তু রাজনৈতিক দল কিংবা সরকার অথবা বিদেশি বিশেষজ্ঞ কেউই সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় গিয়ে আলোচনা তুলছেন না– কেন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রয়োজন! আলোচনা হচ্ছে রাজধানীর সুরম্য অট্টালিকায়– দ্বিকক্ষ কিংবা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নানা বাগ্বিতণ্ডা। যে সামাজিক শক্তিগুলো স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটাল, তারা এসব আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত নয়। কাজেই এসব অপরিচিত বিষয়ের আলোচনায় সাধারণ মানুষ কোনো আগ্রহ পায় না, বরং নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আরও বাড়ে।
এদিকে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে আছে, তা এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে নতুন শব্দ আবিষ্কার করতে হয়। দেশজুড়ে একের পর এক আইনবহির্ভূত অঘটন ঘটছে। আইন ও থানা পুলিশের অস্তিত্বই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। রাষ্ট্রকে মানবিক হতে হবে– স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই তিন খাতে দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারগুলোর সামনে তা উদাহরণ হতে পারত। এসব ব্যাপারে সরকারকে আদৌ কার্যকর বলে মনে হয় না। তারপরও আমাদের আশায় বসতিই সম্বল। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে এখনও আট মাস সময় আছে সরকারের হাতে। এই সময়সীমার মধ্যে তাদের কাছ থেকে দেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাভিত্তিক কর্মসূচি আমরা প্রত্যাশা করি। মানুষের সমঅধিকার প্রশ্নে সরকারের সুস্পষ্ট কর্মসূচি প্রণয়ন ও প্রাথমিক কার্যসূচিও প্রয়োজন।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
[email protected]
- বিষয় :
- গণঅভ্যুত্থান