ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

পরিবেশ

কক্সবাজারের ডুবন্ত বাস্তবতা ও প্রতিকার

কক্সবাজারের ডুবন্ত বাস্তবতা ও প্রতিকার

ফাইল ছবি

মো. ইউসুফ গাজী

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫ | ০০:২০

কক্সবাজার শুধু ‘পর্যটন নগরী’ নয়; পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চল। এ জেলার বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে সমুদ্র, খাঁড়ি, পাহাড়, বন, কৃষিজমি, বসতি– সবই একে অপরের সঙ্গে গভীর জৈব ভূতাত্ত্বিক বন্ধনে যুক্ত। এই অপূর্ব প্রাকৃতিক সমন্বয় দীর্ঘকাল ধরে এখানকার জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মানুষের জীবন-জীবিকার ভারসাম্য বজায় রেখেছে। কিন্তু এই ভারসাম্য আজ নানাবিধ সংকটে ভুগছে। বন ও কৃষিজমি ধ্বংস করে হোটেল, চিংড়ি ঘের, লবণ খামার ও অবকাঠামো নির্মাণের ফলে ভূপ্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে প্রায় ৩৪ শতাংশ এলাকা উচ্চ বা খুব উচ্চ পরিবেশগত ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষত উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির গঠনের কারণে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়েছে। এতে ভূমিক্ষয় বেড়েছে এবং খাঁড়ির প্রাকৃতিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। 

এই প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে পর্যটনের অতিরিক্ত চাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ও অপরিকল্পিত নির্মাণের কারণে সৈকত ও বালিয়াড়ির প্রাকৃতিক কাঠামো ধ্বংস হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, কক্সবাজারের উপকূলীয় বালিতে উচ্চমাত্রায় মাইক্রো প্লাস্টিক কণা শনাক্ত হয়েছে, যার ৭০ শতাংশই সিনথেটিক ফাইবার। সবচেয়ে বেশি দূষণ পাওয়া গেছে লাবণী ও কলাতলী সৈকতে, যা স্পষ্টভাবে পর্যটন ও শহরায়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।   
প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এই ভাঙনের প্রভাবে ভূগর্ভ ও ভূপৃষ্ঠ– দুই ধরনের পানিরই পর্যাপ্ততা ও গুণমান আজ সংকটাপন্ন। মিষ্টি পানির স্তরে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ  ঘটছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা ও মানুষের স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এই সংকটের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূল শতবর্ষে অন্তত ২২টি ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত। ৭ থেকে ১০ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস প্রায় পাঁচ বছর পরপর এ অঞ্চলকে প্লাবিত করছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে এ প্রবণতা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

এই বহুমাত্রিক পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় জরুরি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, টেকসই ও জনসম্পৃক্ত উপকূল ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা। প্রথমত, সৈকত ও বালিয়াড়ি রক্ষায় ‘সেটব্যাক জোন’ নির্ধারণ করতে হবে, যাতে নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ থাকে। যেসব অবৈধ স্থাপনা বালিয়াড়ি ও প্রাকৃতিক বাঁধ ধ্বংস করেছে, সেগুলো অপসারণ করে ‘বালিয়াড়ি পুনর্গঠন’ ও স্থানীয় উদ্ভিদের (ঝাউ, কেওয়া) মাধ্যমে সবুজায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বালিয়াড়ি দিয়ে চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট বোর্ডওয়াক চালু করে জনসচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন নিয়ন্ত্রণে ‘মনিটরিং ওয়েল’ স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। পর্যটন চাপের পরিপ্রেক্ষিতে সৈকতে আধুনিক বর্জ্য বিন, প্লাস্টিক নিষ্পত্তির ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত টয়লেট স্থাপন প্রয়োজন। একই সঙ্গে পর্যটকদের জন্য সচেতনতামূলক নির্দেশনা, জরিমানার ব্যবস্থা এবং স্থানীয় যুবকদের নিয়ে ‘সৈকত সুরক্ষা স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচি’ চালু করা যেতে পারে।

এসব সমাধান সমস্যার মূল জায়গায় কার্যকরভাবে পৌঁছাতে পারে, যদি তা হয় গবেষণাভিত্তিক, টেকসই ও প্রযুক্তি-সহায়ক। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ উপকূল গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং একটি সুসংগঠিত গবেষণা কাঠামো গড়ে তোলা। এর আওতায় নিয়মিতভাবে সৈকতের বালুকণার বিশ্লেষণ, স্যাটেলাইট চিত্র ও ড্রোনের মাধ্যমে সৈকত প্রোফাইলিং, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, ঢেউয়ের শক্তি ও দিকের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ এবং দুর্যোগ পূর্বাভাস বিশ্লেষণ চালানো প্রয়োজন। এই তথ্যগুলো একত্র করে অঞ্চলভিত্তিক ঝুঁকির মানচিত্র তৈরি করা যেতে পারে। জিআইএস প্রযুক্তি এবং মাঠ পর্যায়ের গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশগত ঝুঁকির মানচিত্র তৈরি করে তাতে চাপভিত্তিক জোন করা যেতে পারে। যে কোনো ভবিষ্যৎ প্রকল্প গ্রহণের আগে ভূপ্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু ঝুঁকি ও ভূমি ব্যবহারের ওপর ভূ-পরিবেশীয় বিশ্লেষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এখন সময় এসেছে গবেষণাভিত্তিক প্রস্তাবনা ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার। সমন্বিত পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সর্বস্তরের অংশগ্রহণ না হলে এই উন্নয়ন হবে কাগজ-কলমে সফল; বাস্তবে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাবে।

ইউসুফ গাজী: সহকারী অধ্যাপক,
ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

আরও পড়ুন

×