ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

কেউ দেখেনি হাঙ্গামা, তবু থানায় মামলা

কেউ দেখেনি হাঙ্গামা, তবু থানায় মামলা

কামরুল হাসান

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৩ | ০৬:৪০

কেউ দেখেনি দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও শোনেনি কেউ। তবু রাজধানীর কদমতলী থানায় মামলা হয়েছে ৬৭ বিএনপির নেতাকর্মীর নামে। দলটির দাবি, যখন সরকার পতনের এক দফা চূড়ান্ত আন্দোলন চলছে, তখন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, হয়রানি এবং ভীতি ছড়াতে সারাদেশে এ রকম গায়েবি মামলা জোরদার করেছে সরকার।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে কদমতলীর পূর্ব জুরাইন কমিশনার মোড়ে ওয়াসা পাম্পের সামনে জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় কয়েকজন গুরুতর জখম হন। নয়ন হোসেন নোমান নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী মামলাটি করেন। তিনি নিজেকে থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পরিচয় দেন।

নয়ন হোসেন নোমানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে সমকাল। মামলার এজাহারে হামলার ঘটনা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা উল্লেখ থাকলেও বাদী ঘটনার সময় বিকেল ৪টা বলে দাবি করেন। তিনি জানান, তাদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়া হয়েছে, লাঠি দিয়ে হামলা হয়েছে। তবে কারা হামলা করেছে, তিনি তাদের চেনেন না। তাহলে নাম উল্লেখ করে কীভাবে মামলা করলেন– এ প্রশ্নে তিনি জানান, তিনি কিছু বলতে পারবেন না। আহতদের নাম জানতে চাইলেও তিনি কিছু বলতে পারেননি। এক পর্যায়ে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে ফোনের লাইন কেটে দেন। পরে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি আর ধরেননি।

ঘটনার সময় নিয়ে পুলিশ ও বাদীর দুই রকম বক্তব্যের কোনোটির সত্যতা খুঁজে পাননি এলাকাবাসী। কারণ হিসেবে তারা বলেন, ওই দিন এ এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার কোনো ঘটনা ঘটেনি। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির কোনো সভা-সমাবেশও ছিল না ওই দিন।

ওয়াসাসংলগ্ন ভাঙাড়ি দোকানের মালিক আলমগীর জানান, এ এলাকায় গত কয়েক মাসে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষ হয়েছে– এমন ঘটনা তিনি শোনেননি। সপ্তাহখানেক আগে দুই গাড়িচালকের মধ্যে হাতাহাতি ছাড়া কোনো ঘটনা তিনি জানেন না। ককটেল বিস্ফোরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ককটেল কে ফাটাইবো? এখানে তো কোনো মারামারিই হয়নি।’ ওয়াসার সামনে ঢাকা ডিজিটাল স্টুডিওতে কর্মরত মামুন জানান, তিনিও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা শোনেননি। এলাকার মডার্ন টেইলার্স, একজন দলিল লেখকসহ আরও অনেকের সঙ্গে কথা হলেও এ রকম হামলার ব্যাপারে কেউই তথ্য দিতে পারেননি।

মামলার ৩২ নম্বর আসামি সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওই দিন এ রকম কোনো ঘটনা সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা নেই। কেন মামলা হয়েছে, তাও তিনি জানেন না। ৬৬ নম্বর আসামি এহসানুল হক সুজন জানান, বিএনপির রাজনীতি করাটাই অপরাধ।

কদমতলীর মতো গত ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় জুরাইন কবরস্থানসংলগ্ন ময়লার ডাম্পিংয়ের ফাঁকা জায়গায় আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে মামলা হয়। ঘটনার পরদিন শ্যামপুর থানায় মামলাটি করেন থানা আওয়ামী লীগের সদস্য শাহাদাত হোসেন। মামলায় ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪০-৫০ জনকে আসামি করা হয়। এতে ১ নম্বর আসামি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আ ন ম সাইফুল ইসলামসহ সবাই বিএনপির নেতাকর্মী।

ওই মামলার অভিযোগে বলা হয়, ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জুরাইন কবরস্থান রোড ৩ নম্বর গেটসংলগ্ন ময়লার ডাম্পিংয়ের পাশে শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের একটি কর্মিসভা চলছিল। এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা ও ককটেল বোমা নিয়ে সভায় উপস্থিত নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণের ওপর অতর্কিত হামলা করে। মারধরের এক পর্যায়ে তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে আওয়ামী লীগের অনেকে আহত হন।

তবে এ হামলার বিষয়েও স্থানীয়রা কেউ কিছু জানেন না। সংঘর্ষ হয়েছে এমন দৃশ্যও দেখেননি কেউ। ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও শোনেননি। এমনকি ওই দিন আওয়ামী লীগের কোনো সভা হয়েছে, সে বিষয়েও স্থানীয়রা কিছু জানাতে পারেননি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও জানান, গত বুধবার তাদের কোনো সভা হয়নি। মানিক লাল নামের একজন নিজেকে থানা যুবলীগের সদস্য পরিচয় দিয়ে জানান, ওই দিন তাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। মামলা, হামলা আর ককটেল বিস্ফোরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।

এ ঘটনায় পুলিশ মিজানুর রহমান (৩০), সাদিক হোসাইন (৩৫), ফরহাদ হোসেন (৩২), আশরাফুল ইসলাম শুভ (৩০) ও সমিউর রহমান খান ওরফে দীপু খানকে (৪৩) গ্রেপ্তার করে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে চারটি বিস্ফোরিত ককটেল, জর্দার টিনের কৌটা, লোহার রড তিনটি ও পাঁচটি কাঠের লাঠি। তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, নেতাকর্মীর অন্য জায়গা থেকে আটক করে সাজানো এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আ ন ম সাইফুল ইসলাম জানান, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ঘিরে একের পর এক গায়েবি মামলা দেওয়া হচ্ছে। থানা ভিন্ন হলেও কাকতালীয়ভাবে মামলার অভিযোগের ধরন ও হামলার সময় একই দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া যাদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে, তাদের অন্য স্থান থেকে আটক করে সাজানো মামলায় জড়ানো হচ্ছে। মামলার বিষয়ে শ্যামপুর থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, ঘটনা ঘটেনি এমন অভিযোগ সত্য নয়। কিছু না ঘটলে তো আর মামলা হয় না। সেদিন সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে গিয়ে তারা ঘটনার সত্যতা পান। হয়তো যেভাবে বলা হয়েছে, ততটা নাও হতে পারে। তবে তদন্তে সবকিছু বেরিয়ে আসবে।

বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি ঘোষিত মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘিরে কয়েক দিন ধরেই নেতাকর্মীকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার চলছে। দেশজুড়ে নেতাকর্মীরা ঘরছাড়া। এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাজধানীতে ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে, হামলার ঘটনা ঘটেছে– এমনটা কেউ শোনেনি। এ রকম ঘটলে তো অন্তত গণমাধ্যমে আসত। আসলে ক্ষমতাসীনরা এবারও নেতাকর্মীর নামে গায়েবি মামলা দিতে শুরু করেছে। যাতে আমাদের চলমান আন্দোলনে নেতাকর্মীরা ভয় পায়, হয়রানির শিকার হয়। গায়েবি মামলা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। নেতাকর্মীরা আরও শক্তি নিয়ে, সাহস নিয়ে এ ফ্যাসিবাদকে রুখে দেবে।

আরও পড়ুন

×