শামীমের দ্বৈত নাগরিকত্ব: নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের নথির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ

এ. কে. আজাদ ও শামীম হক- ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২৩:২৬ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১২:১৩
একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের নাগরিক ফরিদপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হক। তিনি নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন বলে দাবি করে নথি জমা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। নথিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেখানে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কনস্যুলার সেবার ঠিকানা, দূতাবাসের লোগো, ফোন নম্বর, ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন জালিয়াতি করে।
শামীম হক দ্বৈত নাগরিক হওয়ায় বুধবার ইসিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে নির্বাচন ভবনে তাঁর প্রার্থিতার বৈধতা নিয়ে শুনানি হয়। পরে শুনানি স্থগিত রেখে ইসি আগামীকাল শুক্রবার রায়ের দিন ধার্য করেছে। আইন অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিক হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না।
শামীম হক নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার যে নথিপত্র জমা দিয়েছেন, তা পর্যালোচনা করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল কাদের (এ. কে.) আজাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান। তিনি সমকালকে বলেন, যে নথিগুলো শামীম হক জমা দিয়েছেন, তার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাঁর নাগরিকত্বের অবস্থা জানতে আপিল মুলতবি করে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে ইসি।
নথিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শামীম হকের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় যে ই-মেইল করা হয়েছে, তা করেছেন আলী আজগর মানিক নামের এক ব্যক্তি। মানিকের এইচসিএইচ আন্ডারস্কোর বিডি অ্যাট ইয়াহু ডটকম ([email protected]) ঠিকানা থেকে করা ই-মেইলে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসে যোগাযোগ করে শামীম হকের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি বারবার তুলে ধরা হয়েছে। সেই ই-মেইলে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কনস্যুলার সেবার ঠিকানা, দূতাবাসের লোগো, ফোন নম্বর, ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়।
মানিকের ওই ই-মেইলটিতে খুঁজে পাওয়া যায় হল্যান্ড চিলড্রেন হাউস নামে একটি এতিমখানার ঠিকানা। সেখান থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় আলী আজগর মানিকের।
এ বিষয়ে জানতে সমকালের পক্ষ থেকে মানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি দূতাবাসের কোন পদে কর্মরত। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি ডাচ দূতাবাসে কাজ করব কেন? আমাদের দূতাবাসের সঙ্গে কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেমন– হল্যান্ড চিলড্রেন হাউস। এর ফলে দূতাবাসের সঙ্গে ই-মেইলে আমাদের যোগাযোগ হয়। আমি দূতাবাসের কোনো পদে নেই।’
তাহলে ইসিতে জমা দেওয়া নথিতে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কনস্যুলার সেবার ঠিকানা, দূতাবাসের লোগো, ফোন নম্বর, ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা ব্যবহার করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের হল্যান্ড চিলড্রেন হাউসে দূতাবাসের কূটনীতিকসহ রাষ্ট্রদূত একাধিকবার এসেছেন। সে কারণে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। তবে দূতাবাসের কোনো কিছু ব্যবহার করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
পরে নথির ছবি পাঠালে সেটি দেখে মানিক বলেন, ‘আমি এখন ফরিদপুরের বাইরে আছি। ফাইল নিয়ে বসে কথা বললে সুবিধা হতো।’
শামীম হকের নাগরিকত্ব কি বাতিল করে দিয়েছে নেদারল্যান্ডস? এ প্রশ্নের জবাবে মানিক বলেন, বাতিল হতে ১০-১১ মাস সময় লাগে। নাগরিকত্ব বাতিলের আবেদন ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসে করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
শামীম হক ইসিতে দাবি করেছেন, তিনি গত ৯ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার আবেদন করেছেন। সেই আবেদন কার কাছে করা হয়েছে, তা নথিতে উল্লেখ নেই। সেই সঙ্গে নথি অনুযায়ী নাগরিকত্ব ত্যাগের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার দূতাবাস থেকে ফিরতি ই-মেইলে ‘হল্যান্ড পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের’ নির্দেশনার জন্য অপেক্ষার কথা জানানো হয়। ‘হল্যান্ড পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়’ বলে কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, ই-মেইলে ইংরেজির যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা এতই দুর্বল, যা কোনো বিদেশি দূতাবাসের কাছ থেকে আশা করা যায় না। নথিতে এটি প্রমাণ হয় না যে এই ই-মেইল দূতাবাস থেকে করা হয়েছে।
নাগরিকত্ব বাতিল চেয়ে ইসিতে যে নথি জমা দেওয়া হয়েছে, তাতে বিভিন্ন স্থানে ই-মেইল যোগাযোগের বেশির ভাগ ৪ ডিসেম্বরের পরে। কিন্তু প্রতিটি ই-মেইলে ৯ নভেম্বর নেদারল্যান্সের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি শামীম হকের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার আবেদন করা নথি দূতাবাসসহ দায়িত্বশীল কারও গ্রহণ করার কোনো প্রমাণ নেই।
আলী আজগর মানিক কে? জানতে চাইলে শামীম হক সমকালকে বলেন, হল্যান্ড চিলড্রেন হাউসের দেখভাল করেন তিনি।
দূতাবাসের নাম ব্যবহার করে মানিককে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগের নির্দেশনা কে দিয়েছে– তা জানতে চাইলে শামীম হক বলেন, ‘কনস্যুলারে ওগুলো পাঠানো যায় না। ওগুলো আমিই তাকে বলেছি। যে ই-মেইল থেকে পাঠানো হয়েছে, সেটি আমার প্রতিষ্ঠানের ই-মেইল।’ এ সময় সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তরের পরিবর্তে অবান্তর বিষয়ে কথা বলতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে ফোনটি কেটে দেন শামীম হক।