ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ স্বজনের

তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ স্বজনের

.

 এম সেকান্দর হোসাইন, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) 

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৫ | ০০:৫০

৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সীতাকুণ্ডে ১০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। খুনের শিকার চারজন আ.লীগ ও অন্য চারজন বিএনপি সমর্থিত লোক বলে দাবি করা হয়েছে। বাকি দু’জন সাধারণ মানুষ। রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার, দখল বাণিজ্য ও দলীয় কোন্দলে এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয়রা জানান। এসব খুন ছিল নৃশংস ও বর্বর। ছেলের সামনে কুপিয়ে ও জবাই করে খুন করা হয়েছে বাবাকে। কাউকে কাদামাটিতে মুখ চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার কাউকে মারধরের পর লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। একজনের লাশ দাফনেও বাধা দেওয়া হয়েছে।
তবে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে হতাশ নিহতের স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, পুলিশ খুনের ঘটনা তদন্তে কিছুটা নিষ্ক্রিয়। অভিযোগ উঠেছে, খুনের ঘটনায় জড়িত অনেকে প্রকাশ্যে ঘুরছেন। পুলিশ জড়িত কয়েকজনকে ধরলেও বেশির ভাগ আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জানা যায়, হত্যার শিকার আওয়ামী লীগ সমর্থক জানে আলমের পরিবার মামলা করেনি। তার মরদেহ ছলিমপুর কাজীপাড়ার পারাবারিক করবস্থানে দাফনও করা যায়নি। তাকে দুই কিলোমিটার দূরে শশুরবাড়ির কাছে কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। জঙ্গল ছলিমপুরে মারধরে আবুল কালামের মারা যাওয়ার ঘটনায় হয়েছে অপমৃত্যুর মামলা। 
এ ব্যাপারে সীতাকুণ্ডে মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবুর রহমান বলেন, ‘যেগুলো খুন সেগুলোর ঘটনায় মামলা হয়েছে। তদন্তকাজও অব্যাহত আছে। আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা পালিয়ে আছে তাদেরও ধরা হবে।’
আধিপত্য বিস্তারের বলি কলিম উদ্দিন : গত ২৯ মে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের দুই পক্ষের সংঘর্ষে কলিম উদ্দিন নামের এক যুবদল কর্মী নিহত হন। উপজেলার ছোট বারৈয়াঢালার দারোগারহাট বাজারে এ ঘটনা ঘটে। 
একটি দোকানে স্থানীয় যুবদলের কয়েকজন নেতাকর্মীর মধ্যে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে তা মারামারিতে রূপ নেয়। সংঘর্ষের সময় কলিম উদ্দিনকে ছুরিকাঘাত করে তাদের দলের প্রতিপক্ষরা। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলা করেন নিহতের মা। দলীয় আধিপত্য বিস্তারের বিরোধে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। মামলার পর পুলিশ দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। 
ছেলের সামনে নাছিরকে কুপিয়ে হত্যা : গত ২৬ মার্চ নিজ দলের প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন সীতাকুণ্ড উপজেলা কৃষক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নাছির উদ্দিন। মোটরসাইকেলে চড়ে প্রতিবন্ধী ছেলে নাফিজ উদ্দিনকে নিয়ে ঈদের নতুন পোশাক কিনতে যাওয়ার সময় বাড়ির কাছেই এ খুনের ঘটনা ঘটে। ছেলের সামনেই কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয় নাছির উদ্দিনকে। স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলের কয়েকজন নেতা এই খুনের নেপথ্যে রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। 
পরিবার বলছে, নাছিরের সঙ্গে এলাকার কারও কোনো বিরোধ ছিল না। দলের কয়েকজন লোক মাটি কাটাসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তার সঙ্গে বিরোধে জড়ান। তারাই প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও জবাই 
করে হত্যা করেন নাছিরকে। নিহতের স্ত্রী মোমেনা আক্তার বাদি হয়ে এজাহারে ৮ জনের না উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
ছলিমপুরে আরমান হত্যা : গত ২ জানুয়ারি দলীয় কর্মীর হাতে খুন হন ছলিমপুর ইউনিয়ন শ্রমিকদলের প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি মীর আরমান। ঘর থেকে মুঠোফোনে ডেকে নিয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে জিম্মি করে ডান পায়ের রগ কাটার পর ছুরিকাঘাত ও কুপিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এলাকায় অধিপত্য বিস্তার ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে তাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ।
নিহত আরমান দুই দশক ধরে এলাকায় ডিশ, ইন্টারনেট ও প্লট ব্যবসা করে আসছিলেন। ৫ আগস্টের পর সেখানে বিএনপির কমিটি ও ছিন্নমূল বস্তিবাসী সংগ্রাম পরিষদের কমিটি গঠন নিয়ে রোকন মেম্বারের সাথে তার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সেই দ্বন্দ্বের জের ধরে আরমানকে খুন হন বলে স্থানীয়দের ধারণা। 
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইউনিয়ন ছাত্রদল যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান রিদোয়ান বলেন, ‘আরমানকে নৃশংসভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে হত্যা করা হয়েছে। মূলত মশিউর, এয়াকুব ও কাঁঠাল পাড়ার ইয়াছিনদের হাতে আরমান খুন হয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য আর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মানুষটিকে হত্যা করা হয়েছে।’
গত ১৭ জানুয়ারি মামলার প্রধান আসামি প্রধান আসামি আল আমিন (২৮) ও ৩ নম্বর আসামি মো. জসিম উদ্দিন প্রকাশ ভুট্টোকে (৩৫) গ্রেপ্তার করে র্যাব-৭ এর একটি দল। 
ঘর থেকে তুলে নিয়ে মাসুদ হত্যা : জঙ্গলছলিমপুরে গত ৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মোহাম্মদ মাসুদ নামে বিএনপির এক নেতা খুন হন। ৫ নম্বর ছিন্নমূল এলাকায় ইট, বালু, কংক্রিটের ব্যবসা দখলে নিতে এই খুনের ঘটনায় ঘটে। স্থানীয় বিএনপির নেতা কামরুল হাসার প্রকাশ রিদোয়ান ও তার সহযোগীরা মাসুদকে বসতঘরে থেকে তুলে নিয়ে খুন করে বলে পরিবারের অভিযোগ।
মারধরের পর কালামকে গাছে ঝুলানো হয় : গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সিডিএ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন জঙ্গল ছলিমপুরে বৃদ্ধ আবুল কালাম খুন হন। তিনি ছিলেন বিএনপির সমর্থক। রাতে নিজ দলেরই প্রতিপক্ষ তাকে মারধর করে বলে অভিযোগ আছে। ঘটনার পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে তার মৃতদেহ গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে ঝুলানো অবস্থায় উদ্ধার করে পরিবারের সদস্যরা। তবে এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোন মামলা হয়নি। 
বোনের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ফিরোজ হত্যা : গত ১৮ অক্টোবর রাতে মো. ফিরোজ খান (৩৫) নামের এক যুবলীগ নেতাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার লালানগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির স্বজনদের অভিযোগ, ফিরোজকে তাঁর এক বোনের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
নিহত ফিরোজ খান বারৈয়ারঢালা ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি উপজেলার উত্তর কলাবাড়িয়া এলাকার মৃত কামাল উদ্দিনের ছেলে।
ফিরোজের ফুফাতো ভাই মোশারফ হোসেন মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার ভাই যুবলীগের রাজনীতি করতেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তিনি নিজের বাড়িতে থাকতেন না। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে তাঁর এক বোনের বাড়িতে থাকতেন। ওই রাত একটার দিকে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল তাঁকে ওই বাড়ি থেকে ডেকে খালি জমিতে নিয়ে যায়। এরপর সেখানে তাঁকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে বোনের বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়।’ যুবলীগ করার কারণেই ভাইকে হত্যা করা হয়েছে বলে মোশারফের দাবি। 
কাদামাটিতে মুখ চেপে ধরে মারা হয় ইউসুফকে: কাদামাটিতে মুখ চেপে ধরে খুন করা হয় উপজেলা কৃষকলীগের আহবায়ক ৬৫ বছর বয়সী মীর ইউসুফকে। অবশ্য স্থানীয় বিএনপি প্রতিবাদ সভা করে দাবি করেছে ইউসুফ স্ট্রোকে মারা গেছে। বিএনপির কেউ তাকে মারেনি। তবে ময়না তদন্ত রিপোর্টে মিলেছে হত্যার আলামত। এ ঘটনায় র্যাব-৭ এর একটি দল অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত এক বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে প্রধান আসামি দেশে ছেড়ে পালিয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
ইউসুফের পরিবারের দাবি, গত ১৬ নভেম্বর জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে ইউসুফকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবেশী বিএনপি নেতা হেলালউদ্দিন, আলাউদ্দিন, আবদুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়। ঘটনার দিন ইউসুফের স্ত্রী গোলস্তারা বেগম থানায় মামলা দায়ের করেন। 
ইউসুফের স্ত্রী গোলস্তারা বেগম বলেন, ‘জমি নিয়ে বিএনপির স্থানীয় এক নেতার পরিবারের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। ঘটনার দিন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতাকর্মীকে এনে বিরোধপূর্ণ জমি পরিমাপ করা হয়। এতে তাঁর স্বামী প্রতিবাদ করলে হেলাল, আলাউদ্দিন, মামুন, সালাউদ্দিনসহ ৪০–৫০ জন আমার স্বামীর ওপর হামলা চালায়। স্বামীকে তিনবার মারধরের পর কাদামাটিতে মুখ চেপে ধরে হত্যা করে। ঘটার পর আসামি হেলাল কুয়েতে পাড়ি জমায়।’
মুসলিমকে কুপিয়ে হত্যা : গত ১০ এপ্রিল মুরাদপুর এলাকায় মুসলিম উদ্দিন (৪২) নামে এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। উপজেলার বেড়িবাঁধ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
মুসলিম উদ্দিন উপজেলার মুরাদপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। তিনি ওই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু তাহেরের ছেলে।
জানা যায়, স্থানীয় বেড়িবাঁধ এলাকায় নির্মাণাধীন একটি কারখানার বাইরে ১০-১২ জন দুর্বৃত্ত দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মুসলিম উদ্দিনের ওপর অতর্কিত হামলা করে। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন ও স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) নিয়ে যান। সেখানে তার মৃত্যু হয়।
মুসলিম উদ্দিনের শ্বশুর বীর মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী মেম্বার বলেন, ‘বেড়িবাঁধ এলাকায় নির্মাণাধীন একটি কারখানাযর সুপারভাইজার ছিল মুসলিম উদ্দিন। দুর্বৃত্তরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাকে জখম করে।’
জানে আলমের লাশ দাফনেও বাধা : গত ৬ ডিসেম্বর মারধরের মারা যায় মোহাম্মদ জানে আলম নামে ৬৩ বছর বয়সী এক আওয়ামী লীগ সমর্থক। ছলিমপুর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামে এই  ঘটনা ঘটে। পরিবারের দাবি, ছলিমপুর ইউনিয়ন যুব দলের সাধারণ সম্পাদক রোকন উদ্দিনের এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, গত ৬ ডিসেম্বর আছরের নামাজের পর ডেঙ্গু রোগে মারা যাওয়া চাচাত বোনের জানাজা পড়তে এলাকার মসজিদে আসেন জানে আলম (৬৫)। জানাজার পূর্বে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা তাকে মারধর করেন। মুমূর্ষু অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। জানে আলম উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কাজী গোলাম মহিউদ্দিনে চাচা।  
 নিহতের ছেলে ফয়সল আলম বাবুল বলেন, ‘ছলিমপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি রোকন ও তার বাহিনী আমার বাবার উপর হামলা করে। রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসলে রোকন ও তার বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সদস্যদের মারধর করে। বাবাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনও করতে দেয়নি। পরে কর্নেলহাট বাদামতলীর জাহানখীল এলাকায় আমার নানাবাড়িতে বাবাকে দাফন করা হয়।’ 
বালু উত্তোলনের বাধা দেওয়ায় রাম দাস হত্যা : গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বাড়বকুণ্ড এলাকায় সাগর থেকে বালু উত্তোলনে বাধা দেওয়া রাম দাস নামের এক জেলেকে খুন করা হয়। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা তাকে খুন করে হাত-পা বেঁধে সাগরে ফেলে দেয়। তিন দিন পর কোস্টগার্ড লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় জড়িত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে নৌ-পুলিশ। হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে। 

আরও পড়ুন

×