করোনাকালে সঙ্কটে প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

রাকিব হাসান রাফি, স্লোভেনিয়া থেকে
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ০৭:৪৩
করোনার ভয়াল থাবায় থমকে গেছে গোটা বিশ্ব। সেই সঙ্গে গোটা পৃথিবীর অর্থনীতিতে নেমে এসেছে বড় বিপর্যয়। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন। তবে করোনার আঘাতে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। প্রায় এক বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সকল বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন তাদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি সঙ্কটাপন্ন।
ইউরোপ কিংবা আমেরিকা অথবা অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে যে সকল শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান তাদের অনেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরিতে মনোনিবেশ করেন। যার মাধ্যমে তাদের অনেকে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচের সংস্থান করেন। তবে করোনা পরিস্থিতিতে তাদের অনেকে দীর্ঘ সময় ধরে সাময়িকভাবে এ সকল খণ্ডকালীন চাকরি থেকে বিচ্ছিন্ন। বিভিন্ন দেশে সরকারের পক্ষ থেকে কর্মজীবীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও শিক্ষার্থীরা থেকে গিয়েছেন তার বাহিরে। অনেকে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিজেদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কোনও উদ্যোগ এ সকল দেশের সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়নি।
তবে বরাবরের মতো করোনার তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী বিদেশের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। যদিও যে সকল শিক্ষার্থী স্কলারশিপের আওয়তায় বাহিরের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন, করোনার এ সময়ে তাদেরকে খুব একটা প্রতিবিন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় নি কিন্তু যারা সেলফ ফাইন্যান্সিং স্টুডেন্ট বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস যেনও তাদের গলায় রীতিমতো ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এ সকল শিক্ষার্থীদের অনেকে দাবি করেছেন বাংলাদেশ থেকে বাহিরে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে অন্তত শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের গতানুগতিক নিয়মের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আরোপ করে।
হাঙ্গেরি প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সাজিন আহমেদ কৌশিক জানান, ‘ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো হাঙ্গেরির অর্থনীতি পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তবে শীতের মৌসুমে খুব বেশি পর্যটকের তেমন একটা আনাগোনা না থাকায় এ সময় ইউরোপের দেশগুলোতে ট্যুরিজম খাত অনেকটা স্থবির থাকে। তাই বছরের এ সময় এমনিতে পার্টটাইম জবের সুযোগ অনেক কমে আসে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনার এ সময়ে এমনিতে দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে আমরা অনেকে জব থেকে বিচ্ছিন্ন। দূতাবাসের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ কারণ এককালীন তারা আমাদেরকে কিছু অর্থ সহায়তা দিয়েছে তবে সেটা টানা কয়েক মাস চলার জন্য যথার্থ নয়। অন্যদিকে বাহিরের দেশ থেকে সহজে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানো সম্ভব হলেও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা আনার সুযোগ অনেক কম। তাই এ পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে কীভাবে আমরা চলবো সেটা বুঝে উঠতে পারছি না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে তিন উপায়ে অর্থ পাঠানো যায়। প্রথম পদ্ধতিটির নাম হচ্ছে অ্যান্ডোর্সমেন্ট। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক ট্রাভেল কোটার আওতায় এক বছরে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করতে পারে। তবে এ জন্য পাসপোর্টে প্রয়োজনীয় ঘোষণা দিতে হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে এলসি। যারা ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পপতি তারা এলসির মাধ্যমে বাহিরের দেশ থেকে কোনও পণ্য কিংবা যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে আমদানি করে থাকেন। আরেকটি উপায়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানো যায় যেটি কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য। প্রথমে একজন শিক্ষার্থীকে কোনো একটি ব্যাংকে গিয়ে স্টুডেন্ট ফাইল ওপেন করতে হয় এবং স্টুডেন্ট ফাইলের বিপরীতে একজন শিক্ষার্থী বাহিরের দেশগুলোতে কেবলমাত্র তার টিউশন ফি ও ক্ষেত্রবিশেষে তার হোস্টেলের ভাড়াও দিতে পারেন। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালে পরিপূর্ণ। এ ছাড়াও বাহিরের দেশগুলোতে ব্যবহারের জন্য অনেকে ভিসা, মাস্টার কিংবা আমেরিকান এক্সপ্রেসের কার্ড ব্যবহার করেন তবে সবাই যে এ সকল ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করতে পারেন তেমনটিও নয়। তাই বিদেশে অবস্থানকালীন সময়ে অনেকে প্রয়োজনীয় অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে হুন্ডির আশ্রয় নেন। সে ক্ষেত্রে যে বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো নিকটস্থ কারও সন্ধান করা, যিনি বাংলাদেশে টাকা পাঠাবেন। তিনি সে টাকা বাংলাদেশে না পাঠিয়ে সরাসরি তার হাতে তুলে দেন এবং বাংলাদেশে থেকে তার পরিবারের কোনোও সদস্য ওই লোকের বিশ্বস্ত কারও কাছে এর সমপরিমাণ অর্থ পৌঁছে দেন। এতে সরকারের রেমিট্যান্স প্রবাহে ঘাটতি তৈরি হয়। এছাড়াও নৈতিক মানদণ্ডের বিষয়টি থেকেও এ হুন্ডি প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ।
অন্যদিকে ইউক্রেন প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মাসুদ বিন পারভেজ বলেছেন, ‘কয়েকদিন আগে আমার জরুরি ভিত্তিতে কিছু টাকার প্রয়োজন হয়, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও আমি ইউক্রেন কিংবা আশেপাশের দেশগুলোতে এমন কাউকে খুঁজে পায়নি যিনি দেশে টাকা পাঠাবেন। ইতালি কিংবা ফ্রান্সে যারা আমার পরিচিত ছিলো করোনার কারণে তাদের অধিকাংশই কয়েক মাস ধরে বেকার। ফলে তারাও আমাকে সাহায্য করতে পারেনি।’
মাসুদ আরও বলেন, ‘ইউক্রেনসহ আশেপাশে যে সকল দেশ রয়েছে বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর কথা যদি বলি অর্থনৈতিকভাবে এ সকল দেশ ইউরোপের অন্যান্য অংশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। এ সকল দেশে এখনও সেভাবে বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে উঠেনি, তাই যে কোনো বিপদে যে একজন আরেকজনের পাশে থাকবে সে অবস্থাও খুব সীমিত। তাই এরকম পরিস্থিতিতে আমি যখন অর্থ সঙ্কটে পড়ি তখন আমাকে বাধ্য হয়ে কানাডায় থাকা আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের সাহায্যে টাকা আনতে হয় কিন্তু এভাবে টাকা আনা অনেক খরচসাপেক্ষ। টাকা উত্তোলনের সময় বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যা রীতিমতো বিব্রতকর। তাই আমি মনে করি বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ক্ষেত্রে যতোটা সম্ভব নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করা উচিত যাতে যে কোনও কঠিন সময়ে আমরা অন্তত দেশ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য গ্রহণ করতে পারি।’
মাসুদ ও কৌশিক উভয়ই মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশ থেকে বাহিরের দেশগুলোতে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে গতানুগতিক নিয়মের পরিবর্তন আনে তাহলে হুন্ডির মতো বিষয়গুলো অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।