তিস্তার পার থেকে জার্মানির ল্যাবে

শামসুল আকরাম সুমন
জসিম উদ্দিন আকাশ
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪ | ২২:৩৪
শামসুল আকরাম সুমন। গাইবান্ধার কড়াইবাড়ি গ্রামের এই স্বপ্নবাজ কাজ করছেন জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব দ্য বুন্দেসভেয়ার মিউনিখে রোবটিকস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। অভাব-অনটনের সংসার থেকে কেমন করে এগিয়ে গেলেন স্বপ্নের পথে, সেই গল্প শুনেছেন জসিম উদ্দিন আকাশ
১৯৯৮ সালে তিস্তার ভাঙনে বাপ-দাদার সব সম্পদ নদীতে চলে যায় শামসুল আকরাম সুমনদের। জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। শুরু হয় অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট! স্কুলশিক্ষক বাবা শিক্ষকতার পাশাপাশি আট ভাইবোনের খরচ মেটাতে জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন। বাবার সঙ্গে কাজ করতেন সুমনরাও। উদ্দেশ্য একটাই, পরিবারে সচ্ছলতা ফেরানো। অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠা শামসুলের প্রবল ইচ্ছা ছিল আইনজীবী হওয়ার। অন্যদিকে বাবা চাইতেন ছেলে চিকিৎসক হোক। কোনোটাই হতে পারেননি শামসুল। পারিবারিক টানাপোড়েনের কথা চিন্তা করে ভর্তি হন রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। তার পরের যাত্রা অনেকটা স্বপ্নের মতো!
শৈশব ও ফেলে আসা দিন
গাইবান্ধার কামারজানির কড়াইবাড়িতে শামসুল আকরাম সুমনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সচ্ছল পরিবার। জমিজমাও ছিল অনেক। দাদা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিস্তার ভাঙনে সব বিলীন হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় অভাব-অনটনের দিন। আট ভাইবোনের পরিবার। টানাপোড়েন লেগেই থাকত। শামসুল আকরাম সুমন বলেন, ‘নদীভাঙন সব শেষ করে দেয় আমাদের। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী বাবার স্কুলের চাকরির সামান্য আয়ে অভাব-অনটনে কাটে আমার শৈশব। বাড়ির পাশে কড়াইবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে পঞ্চম শ্রেণি শেষ করি। ২০০৬ সালে কামারজানি মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। বাবাও সেই স্কুলের শিক্ষক। নিজের প্রবল ইচ্ছা ছিল আইনজীবী হবো। তাই বাবার ইচ্ছা ডাক্তারি পড়ার কথা কানে তুলিনি, কারণ আমি ভালো করেই জানতাম আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্যের কথা। ২০১১ সালে এসএসসির পরে হঠাৎ করেই পলিটেকনিকে ভর্তি পরীক্ষার ইচ্ছে জাগে। কম্পিউটার সায়েন্সে রংপুর পলিটেকনিকে চান্স পাই। তখন সবার পরামর্শে আইনজীবী-ডাক্তারি সব চিন্তা বাদ দিয়ে শুরু করি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া। মেজো ভাইয়ের সহযোগিতায় ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাই ঢাকার ফ্লোরা টেলিকমে। এরপর সিদ্ধান্ত নিই দেশের কোনো একটি আইটি কোম্পানিতে ম্যানেজারিয়াল পদে কাজ করতে পারলেই আমার জীবন ধন্য! এ লক্ষ্যে চাকরি শুরু করি ওয়ালটনে আইটি অফিসার হিসেবে। রাতে বিএসসির ক্লাস, দিনে চাকরি।’
ইচ্ছের পিছু ছুটে চলা…
২০১৬ সালে প্রাইম ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর পড়া শুরু করেন শামসুল আকরাম সুমন। একই বছর উত্রা ইউনিভার্সিটিতে ল্যাব সহকারী হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি লক্ষ্য স্থির করেন, দেশসেরা প্রাইভেট বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটিতে যোগ দেবেন। শুধু তাই নয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে র্যাঙ্কিংয়ের শুরুর দিকে। বছর ঘুরতেই ২০১৭ সালে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ট্রিপল-ইর কম্পিউটার ল্যাবে। বেতন-ছুটি-সুন্দর পরিবেশ–সব মিলিয়ে জীবন বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু ওই যে, আরও ভালো কিছু করার ইচ্ছে! সেই ইচ্ছে তাঁকে ভালো থাকতে দেয় না; নিয়ে যায় আরও উঁচুতে!
যেভাবে জার্মানিতে
২০১৯ সালের শেষের দিকে বিএসসি শেষ করে আবেদন করেন বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এশিয়ার বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পেলেও তাঁর লক্ষ্য ছিল ইউরোপ। শেষমেশ জার্মানি থেকে অফার লেটার এলেও করোনার কারণে পড়ে যান ভিসাসংক্রান্ত জটিলতায়। এরপর দীর্ঘ ২৫ মাস অপেক্ষার পরে জার্মানির বিমান ধরেন শামসুল আকরাম সুমন। ২০২২ সালে শীতকালীন সেমিস্টারে বার্লিন ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেসে ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশনস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স শুরু করেন।
পড়ার পাশাপাশি চাকরি
বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আগেই জেনেছিলেন, রাইডিং কোম্পানিতে চাকরি করলে বেতনের পাশাপাশি ভালো অঙ্কের বকশিশ পাওয়া যায়। জার্মানি এসেই তাই রাইডিং কোম্পানির খোঁজ শুরু করেন শামসুল। একটা কোম্পানি পেয়েও যান, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয় না। পরে বহুজাতিক কোম্পানি ডেলোয়টি জিএমবিএইচ ও টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ডার্মস্ট্যাডে কাজের সুযোগ পান। সর্বশেষ যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব দ্য বুন্দেসভেয়ার মিউনিখের রোবটিকস ল্যাবে। রোবটিকস প্রকৌশলী হিসেবে সেখানে তাঁর কাজ এমবেডেড সিস্টেম বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপে এবং অধ্যাপকদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সহযোগিতা করা; রোবটিকসের বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়নে কাজ করা।
ব্যস্ততা ও আগামীর স্বপ্ন
নিজের ব্যস্ততা সম্পর্কে শামসুল আকরাম সুমন বলেন, ‘খুব ব্যস্ত সময় পার করছি এখন। জার্মানিতে দুটি মিলিটারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব দ্য বুন্দেসভেয়ার মিউনিখ অন্যতম। এখানে এমবেডেড সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের ব্যাচেলরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপে এবং প্রফেসরদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সহযোগিতা করি। এ ছাড়া হার্ডওয়্যার ও রোবটিকস নিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্টে সরাসরি কাজ করি। এখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটিকসের প্রাধান্য। আসলে এখানে পাবলিক বা প্রাইভেট যে কোনো প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধায় তেমন পার্থক্য নেই। বেতন স্কেলে পদবি অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয়। পাশাপাশি জব সিকিউরিটি ও পেনশন সিস্টেম সব প্রতিষ্ঠানেই ভালো। চাইলে ভাষা, সাঁতার কোর্সসহ নানা রকমের কোর্স করে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়। রোবটিকস খাতের সম্ভাবনার কথা অনেকেই জানেন। নিজেকে রোবটিকস প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে চাই আরও। অংশ নিতে চাই ভবিষ্যতের এই প্রযুক্তি বিপ্লবে।’
- বিষয় :
- স্বপ্ন